প্রবন্ধ ২...
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিন্তু বহু লড়াই চলছে
শেষ পর্যন্ত সংসদে লোকপাল বিল পাশ হয়েছে। লোকপালের ইতিহাস দীর্ঘ। প্রায় অর্ধ শতক আগে, ১৯৬৬ সালে দেশের প্রথম প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন রিপোর্ট পেশ করেছিল। এই রিপোর্টে একটি সুপারিশ ছিল, সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতির প্রতিকারের জন্য কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য স্তরে একটি বিশেষ ‘ওমবুডসমান’ অর্থাৎ নজরদার তৈরি করা হোক। কেন্দ্রীয় নজরদারের নাম হবে লোকপাল, রাজ্য স্তরে লোকায়ুক্ত। কর্নাটকে ১৯৮৪ সালে লোকায়ুক্ত তৈরি হয়। আরও অনেক ক’টি রাজ্যে ইতিমধ্যে লোকায়ুক্ত কাজ শুরু করেছে। এই বিষয়ে প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব আইন আছে। বিভিন্ন রাজ্যে লোকায়ুক্তের এক্তিয়ার ও কর্মপদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের। এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মাত্রাও বিভিন্ন, এবং সেটা অনেকাংশেই ব্যক্তিনির্ভর। লোকায়ুক্ত নিজে থেকে দুর্নীতির তদন্তে উদ্যোগী হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত নিতান্ত বিরল। লোকায়ুক্তের এক্তিয়ারও সচরাচর সীমিত। তিনি দণ্ডদানের সুপারিশ করতে পারেন মাত্র, শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই।
কেন্দ্রীয় স্তরে লোকপাল গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। বার দশেক লোকপাল বিল তামাদি হয়ে গেছে, আবার নতুন করে বিল আনতে হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে দেখলে ২০১৩ সালকে রীতিমত ঐতিহাসিক বলতেই হয়। তবে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাকে কতটা স্বাধীন রাখা যায়, তার উপরেই। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হংকঙের ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন আগেনস্ট কোরাপশন (আই সি এ সি) একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এ দিক থেকে দেখলে লোকপাল আইনটির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে যে বিলটি এনেছিল, অণ্ণা হাজারেদের চাপে তার তুলনায় লোকপালকে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট বলে মনে হয় না।
অধিকারের দাবি। এম কে এস এস আয়োজিত এক সমাবেশের প্রস্তুতি। ২০১৩। সৌজন্য: এম কে এস এস।
লোকপাল এবং লোকায়ুক্ত নিয়ে সাম্প্রতিক শোরগোলের তোড়ে একটা কথা ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। দুর্নীতি নিবারণে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরির নানা উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের রাইট টু ইনফর্মেশন (আর টি আই) বা তথ্যের অধিকার আইন (২০০৫)। এই আইনের একটা পরিপ্রেক্ষিত ছিল। ১৯৯০’এর দশকে মজদুর কিসান শক্তি সংগঠনের (এম কে এস এস) উদ্যোগে তথ্যের অধিকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তার পরিণামে অনেকগুলি রাজ্যে আর টি আই প্রণীত হয়: তামিলনাড়ু, গোয়া, রাজস্থান, কর্নাটক, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, অসম, মধ্যপ্রদেশ এবং জম্মু ও কাশ্মীর। আর টি আই নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন আছে। অভিযোগ আছে, এই আইন মারফত যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক জরুরি তথ্য আইনের আওতায় রাখা হয়নি, ইত্যাদি। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, এই আইন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে এর সাফল্য বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম।
দ্বিতীয়ত, ১৯৯৭ সালে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে চালু হয়েছিল ‘সিটিজেনস চার্টার্স’ বা নাগরিক সনদ তৈরির উদ্যোগ। শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, বিভিন্ন রাজ্যের সরকার যাতে ঠিক ভাবে কাজ করে, সে জন্য চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই উদ্যোগ। এই সনদ কতটা কার্যকর হয়েছে, তা যাচাই করার জন্য ২০০৭ সালে বেঙ্গালুরুর এক সংস্থা একটি বড় সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যায়, বিভিন্ন রাজ্যের ফল বিভিন্ন রকম, তাদের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতে তুলনায় ভাল কাজ হয়েছে। তবে সামগ্রিক ভাবে, চার ভাগের তিন ভাগ নাগরিক এই উদ্যোগটির কথা জানেনই না!
তৃতীয়ত, যাঁরা কোনও দফতর বা প্রতিষ্ঠানের ভিতরের দুর্নীতির কথা ফাঁস করে দেন, সেই ‘হুইস্লব্লোয়ার’দের রক্ষাকবচ দেওয়ার জন্য আইন করার উদ্যোগ চলছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা একটি বিল অনুমোদন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের আইন আছে। এ দেশে এই রক্ষাকবচ খুবই জরুরি। সত্যেন্দ্র দুবে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার পরে কী ভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। চতুর্থত, ২০০৭ সাল থেকে ফিফথ পিলার নামে এক অসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ‘জিরো রুপি নোট’ চালু করা হয়েছে। সরকারি কর্মী বা অফিসার ঘুষ চাইলে এই টাকা দেওয়া হবে— এটাই হল প্রতিবাদের কৌশল। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদে এই কৌশলে কিছু কাজ হয়েছে। টাটা টি এবং বেঙ্গালুরুর জনাগ্রহ সংগঠন যৌথ ভাবে ‘জাগো রে’ অভিযানের কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জরুরি বিষয়ে জনচেতনা জাগিয়ে তোলাই এই অভিযানের লক্ষ্য। জনাগ্রহ-র আর একটি উদ্যোগের নাম: ‘আইপেডাব্রাইব’। কথাটা এসেছে ‘আই পেড আ ব্রাইব’ থেকে। ইন্টারনেট মারফত নাগরিক জানাতে পারেন, কবে কোথায় কাকে কেন ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এ সব উদ্যোগের ফলে সরকারি দুর্নীতির প্রকোপ কিছুটা কমে, দুর্নীতিগ্রস্তরা একটু সাবধান হন, নাগরিকরা একটু সাহস পান। তা ছাড়া এই সব সূত্রে দুর্নীতি সম্বন্ধে কিছুটা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তথ্যগুলি সব সময় যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয় বটে, তবু একটা ধারণা তৈরি করা যায়। যেমন দেখা যাচ্ছে, ঘুষের মোট অঙ্কের বিচারে দেশের প্রথম পাঁচটি শহর হল বেঙ্গালুরু, দিল্লি, লখনউ, মুম্বই এবং হায়দরাবাদ।
পঞ্চমত, বেঙ্গালুরুর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স সেন্টার-এর ‘সিটিজেন রিপোর্ট কার্ড’ নামক প্রকল্পটির কথা বলা যায়। বিভিন্ন জনপরিষেবা কেমন কাজ করছে, এই কার্ড তার হিসেব দেয়। এই ব্যবস্থাটি ঠিক ভাবে ব্যবহার করলে জনপরিষেবা সরবরাহকারী দফতর বা সংস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করা যায়, তাতে পরিষেবায় কিছু কিছু উন্নতিও হয়। বাস্তবে এমনটা হয়েছে। দুর্নীতিও কিছুটা কমেছে। হায়দরাবাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ কলেজের সংশ্লিষ্ট সেন্টার ফর ইনোভেশনস ইন পাবলিক সিস্টেমস (সি আই পি এস) একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বিভিন্ন পরিষেবা সরবরাহকারীর কাজ অনুসারে মূল্যায়ন করে।
ষষ্ঠত, মধ্যপ্রদেশে শুরু হয়েছে এক নতুন উদ্যোগ। ২০১০ সালে সে রাজ্যে পাবলিক সার্ভিস গ্যারান্টি অ্যাক্ট জারি হয়। জন্ম, মৃত্যু, বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ক সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে জল সরবরাহ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নাগরিককে পরিষেবা পৌঁছে দিতে হবে, এটাই এই আইনে বলা হয়েছে। দেরি হলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে জরিমানা দিতে হবে। জম্মু ও কাশ্মীর, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, হিমাচল প্রদেশ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং পঞ্জাবে অনুরূপ আইন প্রণীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারও এই ধরনের আইন আনতে পারে।
সরকারি কাঠামোর দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। প্রশ্ন হল, শুধু অভিযোগ না করে আমরা কিছু করতে পারি কি? প্রতিকারের কোনও উপায় আছে কি? যে দৃষ্টান্তগুলি দিলাম, সেগুলি এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রাসঙ্গিক। এগুলো বলে দেয় যে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কিছু নেই। দুর্নীতি বিস্তর, তা দূর করা সহজ নয়, কিন্তু আমার মনে হয়, আস্তে আস্তে সমাজ তার বিরুদ্ধে শক্তিও সংগ্রহ করছে, লড়ছে, তাতে কিছু কিছু কাজও হচ্ছে। অন্তত কিছু রাজ্যে। বিশেষত শহর এলাকায়।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.