আমি বিদেশে থেকে আম আদমি পার্টির উত্থানকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাইনি। তাই, আপতভাবে যা মনে হয়, বলি। মাথায় রাখা ভাল যে, এএপি এখন নতুন, আর বছর পাঁচেক বা দশেক পরে একে কী ভাবে দেখব, এখন তা জানি না। ‘সিভিল সোসাইটি’ বা ‘সুশীল সমাজ’ অ-রাজনৈতিকই হওয়ার কথা। তা না হলে, জীবনে নিত্যকার যে স্বার্থের লড়াই, যার পরিণতি সচরাচর সামাজিক সালিশি কিংবা আইনের দরবারে, তা রাজনীতি-নির্ভর হয়ে রাষ্ট্রের ধারক-বাহকদের সমাজের অনেক কলহ ও প্রতিযোগিতায় টেনে আনে। ফলে রাষ্ট্র তার ‘সর্বজনীন’ স্বার্থ দেখার দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা হারিয়ে নানান স্বার্থের লড়াইয়ে কোনও বিশেষ স্বার্থযুক্ত পার্টির— পার্টি বলতে কেবল রাজনৈতিক দল বোঝাচ্ছি না, কথাটা বৃহত্তরে ইংরেজি অর্থে বলছি— হাতে একটি অস্ত্র মাত্র হয়ে দাঁড়ায়। (যে কারণে আমরা সরকারি আমলা ও মন্ত্রীদের মধ্যে কিছু কিছু লোক পেলে নিশ্চিন্ত বোধ করি)। এএপি, শেষ পর্যন্ত, একটা পার্টি। পার্টি মানেই তা সবার স্বার্থে নয়, না হলে তো ‘পার্টি’ বলতাম না! কোনও পার্টি যখন দাবি করে, সে সবার স্বার্থে, তখন পার্টি ও স্টেট গুলিয়ে গিয়ে টোটালিটারিয়ান বা সর্বাধিপত্যকামী সরকার তৈরি হয়। এএপি দাবি করছে, তারা আম আদমি নামক সাধারণ মানুষের একটা ‘স্বার্থসমষ্টি’র পক্ষে।
এখন এটা তো ঘটনা যে, সরকার আর পার্টি আলাদা হয়ে সরকার যে দল-এর ওপরও সাধারণ স্বার্থের (জেনারেল বা পাবলিক ইন্টারেস্ট) পক্ষে একটা কিছু হতে পারে, ভারতের মানুষ নানান ঐতিহাসিক কারণে এই বিশ্বাস বা প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলেছে। দেশের সর্বত্রই সরকার দলের হাতে যন্ত্র বা অস্ত্রবিশেষ হয়ে পড়েছে। ফলে একটা বিশেষ অবস্থায় কোনও একটা দল যদি দলীয় রাজনীতির পরিচিত ছকের বিরোধী একটা স্বতন্ত্র চরিত্রের দল হওয়ার কথা বলে, তা হলে মানুষের সরকার সম্বন্ধে প্রত্যাশার যে জায়গাটা ছিল যে, সরকার সকলের, সেই জায়গাটা সে-দল নিয়ে নিতে পারে। |
অর্থাৎ, এএপি যেন দল হয়েও দল নয়, যেন সে নিজেই একটা গণকণ্ঠস্বর (ভক্স পপুলি), যেন ভ্রষ্টাচারী ব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার অবস্থান। এই অর্থে সে যেন দল হয়েও নির্দল। আমাদের জাতীয় জীবনে নানান চেহারার দুর্নীতিতে ব্যক্তি-মানুষের অংশ নেওয়া সত্ত্বেও ‘দলের ওপরে, সবার বা সর্বসাধারণের জন্য’ এই যে জায়গাটা, তা নিয়ে একটা হাহাকার আছে। আমরা চাই, এই সরকার তৈরি হোক, যা দৈনন্দিন স্বার্থের সংঘাতের ওপরে কোথাও আমাদের মেলাবে। অনেক সময়েই কিন্তু আমরা ঘুষ দেওয়া বা নেওয়ার পক্ষে যুক্তি খাড়া করি যে, না নিয়ে আমার উপায় ছিল না, আমরা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসহায়। এই অসহায়তার জায়গা থেকে কেউ আমাদের উদ্ধার করুন, এই রকম একটা বাসনা অনেকের মনেই থেকে যায়।
একটা সমস্যা হল, এই সরকারি ‘সর্বসাধারণ’-এর জায়গাটা আসলে প্রাতিষ্ঠানিকের চাইতেও বেশি প্রক্রিয়ানির্ভর। অর্থাৎ, পুলিশ, প্রশাসন, আদালত ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া চালু থাকলে তখন মানুষের এই রকম একটা ধারণা হতে পারে যে— হ্যাঁ, এই প্রক্রিয়াগুলো আমাকে ন্যায় এনে দেবে। আমাদের রাজনীতিতে আমরা প্রক্রিয়াকে শুধরানোর বদলে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করি বা নতুন আইন জারি করি। ভাবি, সিবিআই থাকলে ঠিক হবে, লোকপাল থাকলে ঠিক হবে। কিন্তু সিবিআই বা লোকপালের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া যে ঠিক মতো চলবে, তা কী করে নিশ্চিত করব? এখানে হয়তো নিদেনপক্ষে অনেক বেশি প্রশাসনিক সংস্কারের প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত রিপোর্টগুলোয় ওপর সচরাচর ধুলোই জমে। এই কারণে একটা প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হলে আমরা আর একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার দায় এড়াই। তার পর সেটা ব্যর্থ হলে আবার একটা আইন বা প্রতিষ্ঠান, এই ভাবে চলে। চলন্ত ‘প্রক্রিয়া’র বদলে একটা স্থাণু কিছু তৈরি হয়। এই তৈরি হওয়ার মধ্যে যেটুকু সত্যিই প্রক্রিয়াগত ও গণতান্ত্রিক, সেটার চরিত্র আমাদের দেশে আন্দোলনের। দুর্ভাগ্যবশত, আন্দোলনই হয়তো আমাদের সবচেয়ে বেশি গভীর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগত অভিজ্ঞতা। আমরা তো প্রতিষ্ঠানের ভিতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খুব একটা দেখি না।
এএপি-র বিবর্তন হবে। তাদের দাবিগুলো এখন একটা ‘রামধনু’ কোয়ালিশনের মতো লাগছে। সনিয়া গাঁধী বা রাজনাথ সিংহের কাছে যে দাবিপত্র তারা রেখেছে, তার কিছু কিছু সত্যিই প্রক্রিয়াগত। যেমন, বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থাগুলির বাধ্যতামূলক হিসাবপরীক্ষার ব্যবস্থা; কতকগুলো আবার খুবই পপুলিস্ট, খানিকটা ‘রোটি কাপড়া অওর মকান’-এর মতো। যেমন, ঝুপড়ির মানুষদের পাকা বাড়ি এখনই বানিয়ে দাও বা বেআইনি বস্তি আইনি করো। এখন, শেষের উদাহরণগুলো খুবই বোধগম্য। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যে অনেক সময়ই মানুষের জীবনের সঙ্গিন অবস্থার ঠেলায় অনেক প্রশ্ন উঠে আসে, সেটাই এই ধরনের দাবির চেহারা নেয়। সত্যিই তো, ঘরবাড়ির নিশ্চিন্তি, উচ্ছেদ বন্ধ হওয়া— এগুলো প্রয়োজন। কিন্তু এর দুটো পন্থা আছে। একটা পন্থা হল উচ্ছেদের প্রক্রিয়াটিকে ন্যায্য ও পরিষ্কার করা, যাতে গরিব মানুষ অন্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়তে পারেন। এখানে একটা স্বচ্ছ আইন ও পুলিশি ব্যবস্থা লাগে। অন্য পথটা হল, যা বেআইনি তাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার সাহায্যে আইনি করতে দেওয়া। এই দাবিটা আমাদের দেশে পুরনো: পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু রাজনীতিতে হয়েছিল, বস্তিবাসীদের রাজনীতিতে প্রায় সর্বত্রই হয়ে থাকে। কিন্তু তার ফলে কী হয়? শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা বা অন্যান্য পরিকাঠামো তাল রাখতে পারে না বলে আমরা সবাই ভুগি। সকলেরই ‘জীবনের মান’ পড়ে যায়। যেগুলো সত্যিই সবার জন্য হওয়া উচিত, যেমন পরিবেশ রক্ষা, সেগুলোই সবচেয়ে অবহেলিত হয়। মূলধন সৃষ্টির ক্ষেত্রেও মুশকিল হয়। বেআইনিকে রাজনীতি দিয়ে আইনি করার যে প্রক্রিয়া, তার পরিণতি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’। তা বাজারের চরিত্র বদলে অর্থনৈতিক উন্নতি আটকায়। তাৎক্ষণিক ভাবে দেখলে, এই রাজনীতির বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই। সত্যিই তো, গরিব মানুষ ভুগবে কেন? কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভাবলে এই রাজনীতি ‘সর্বজনীন স্বার্থ’-এর পক্ষে ক্ষতিকর। প্রক্রিয়া সংস্কারের বদলে আইন করার রাজনীতিই সে বহাল রাখে। কেজরিওয়াল সবাইকে বলেছেন, ‘আমাকে এস এম এস করে জানাও তোমরা কী চাও— আমরা কি সরকার তৈরি করব?’ উনি বা যোগেন্দ্র যাদব, এঁরা নিশ্চয় জানেন, এ ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আমরা যদি সর্বস্তরে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র করতে পারতাম, তা হলে তো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দরকারই হত না।
গোড়ার প্রশ্নে ফিরে আসি। অরাজনৈতিক সুশীল সমাজের জায়গা এএপি কি নষ্ট করে দিল? হ্যাঁ ও না, দুটোই। এখনও কিন্তু একটা রাজনৈতিক সুশীল সমাজের দাবি ওঠে আমাদের জীবনে। অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে: ‘সুশীল সমাজ ওঁর অপসারণ দাবি করছেন না কেন?’ আবার এটাও ঠিক যে, কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে সুশীল সমাজের কাজ একটা সীমার পর ফুরিয়ে যায়। বড় জোর সেই আন্দোলন আমাদের আর একটা ভোটের বা আইনের দোরগোড়া পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে, যেমন সিঙ্গুর ইত্যাদির পর হয়েছিল, বা দিল্লিতে ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২’র ধর্ষণের পর। এই জায়গাটা পুরোটা এএপি’র জন্য ধ্বংস হবে বলে মনে হয় না। সে যতই একটা বিশেষ দল হয়ে উঠবে, ততই এই জায়গাটা আবার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। কারণ, কোনও দল ‘সর্বজনীন’ হতে পারে না, তা হলে তাকে ‘দল’ বলব কেন? আবার, যেহেতু সুশীল সমাজের ভূমিকা সীমাবদ্ধ, ফলে একটা আন্দোলন ফুরোলে মানুষের মনে আবার প্রশ্ন উঠবে, সুশীল সমাজ কি একটা প্রতিষেধক হিসেবে যথেষ্ট?
তবে এটা কেউ বলতেই পারে যে, আমাদের জীবনে ‘রাজনৈতিক, কিন্তু নির্দল’ বলে পরিচিত এই সুশীল সমাজ বস্তুটিই হালে তৈরি হয়েছে— এর অস্তিত্ব সত্যিই প্রক্রিয়াগত, কারণ এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নেই। সাধারণত, রাজনৈতিক দলগুলো এই জায়গাটা কব্জা করতে চায়। এএপি দেখাল যে, অবস্থা বিশেষে এখান থেকেও একটা ‘দল’ উঠে আসতে পারে। কিন্তু ভারতে যেখানে আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী এবং মানুষের জীবনের সমস্ত দিক গ্রাস করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর, সেখানে তারা চট করে এই রকম একটা নতুন দলকে বিশেষ বাড়তে দেবে না— পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় দলের পক্ষে সত্যিই বিপজ্জনক হয়ে উঠলে পেটাবে। ফলে সুশীল সমাজের সেই ‘নির্দল’ হওয়ার জায়গাটা খানিকটা খোলা-ই থাকবে বলে মনে হয়।
|