রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কি আপন নীতিগত অবস্থান বদলাইতেছে? প্রশ্নটি উঠিয়াছে গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নূতন ঋণ নীতি ঘোষণার পরে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ঋণ সংক্রান্ত নীতি ঘোষণা করে। বাজারে ঋণের জোগান কেমন থাকিবে, সেই ঋণের জন্য কী সুদ দিতে হইবে, সেই সকল বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নির্দেশ বা সংকেত পাওয়া যায় এই নীতিপত্রগুলিতে। গত ১৮ ডিসেম্বর ঋণ নীতি সংক্রান্ত নূতন ঘোষণার দিনে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন জানাইয়াছেন, সুদের হার আপাতত অপরিবর্তিত থাকিবে। সুদের হার বলিতে প্রধানত যে হারে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ধার লইতে পারে। এই হারটিই ঋণের বাজারে সাধারণ ভাবে প্রতিফলিত হয়, এই হার বাড়িলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়ে, ফলে ঋণের চাহিদা সংকুচিত হয়। এ বারের ঘোষণার আগে সাধারণ ভাবে ধরিয়া লওয়া হইয়াছিল যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াইবে। ধরিয়া লইবার কারণ: মূল্যস্ফীতি। পাইকারি মূল্য সূচক নভেম্বর মাসে গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ৭.৫ শতাংশ বেশি হইয়াছে। পাশাপাশি, গত ১৪ মাসে ইহাই সর্বাধিক মূল্যবৃদ্ধি। নীতিপত্র ঘোষণার এক সপ্তাহ আগে ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচক বৃদ্ধির হার ১০.২ শতাংশ হইতে এক লাফে ১১.২ শতাংশে পৌঁছাইয়াছে। অর্থাৎ, বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে নাই, বাড়িতেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘প্রথম’ লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তাহার প্রধান উপায় চাহিদা সংকোচন। সুদের হার বাড়াইয়া সেই উদ্দেশ্য সাধনই পরিচিত রীতি। এই কারণেই ধরিয়া লওয়া হইয়াছিল, সুদ চড়িবে। গভর্নর রাজন সুদ অপরিবর্তিত রাখিবার ফলে প্রশ্ন উঠিয়াছে, তবে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আর তাঁহার প্রধান লক্ষ্য নয়?
গভর্নর রাজন এই প্রশ্নের উত্তরে যাহা বলিয়াছেন, ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে তাহা তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁহার বক্তব্য প্রধানত দুইটি। এক, গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সুদের হার বাড়াইয়াছেন, ঋণের বাজারে তথা বিভিন্ন পণ্যের চাহিদার উপরে এখনও তাহার পূর্ণ প্রভাব পড়ে নাই। তাহার জন্য আরও কয়েক মাস সময় লাগিবে। একই সঙ্গে, নূতন ফসল উঠিবার ফলে বাজারে জোগান বাড়িবে। উভয়তই মূল্যস্তরের ঊর্ধ্বগতি প্রশমিত হইবার সম্ভাবনা। সুতরাং এখনই নূতন করিয়া সুদ বাড়াইবার প্রয়োজন নাই। দুই, অর্থনীতির বৃদ্ধি-হার ভাল নয়, গত কয়েক মাসে তাহার সম্ভাব্য গতি ক্রমাগতই কমিয়াছে। এই অবস্থায় সুদের হার আরও বাড়াইলে বিনিয়োগ এবং লেনদেন ব্যাহত হইবার আশঙ্কা প্রবল, তাহা আয়বৃদ্ধির প্রতিকূল। অর্থাৎ, তাহার ফলে মন্দার আশঙ্কা তীব্রতর হইবে। এই দ্বিতীয় শঙ্কাটি বলিয়া দেয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে যতটা জোর দিতে পারিতেন বা যতটা জোর দেওয়া যথাযথ মনে করিতেন, ততটা পারিতেছেন না।
অন্য ভাবে বলিলে, অর্থনীতির মন্দাক্রান্ত অবস্থা রঘুরাম রাজনকে মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা কিছুটা মানিয়া লইতে বাধ্য করিয়াছে। আয়বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির এই পারস্পরিক টানাপড়েন অর্থনীতির তত্ত্বে বহু-আলোচিত। সমস্যা একটিই। মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা যদি কমানো না যায়, তবে সুদের হার কম এবং ঋণের জোগান বেশি রাখিয়াও চাহিদায় উৎসাহ দেওয়া কঠিন। সে ক্ষেত্রে মূল্যস্তর বাড়িতেই থাকে, আয়বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় না। ভারত আপাতত সেই দ্বৈতসংকটের মুখে দাঁড়াইয়া আছে। |