চলতি বৎসরে রাহুল গাঁধীর রাজনৈতিক সাফল্য যেমনই হউক, এই বিষয়ে কোনও তর্ক নাই যে, তিনি অনেক বার শোরগোল তুলিয়াছেন। দণ্ডিত জনপ্রতিনিধিদের রক্ষাকবচ দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অর্ডিন্যান্সকে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলিবার বিপ্লবী পরামর্শ দেওয়া বা দারিদ্রকে ‘একটি মানসিক অবস্থা’ হিসাবে বর্ণনা করা, ২০১৩ সাল জুড়িয়া রাহুল যাহাই বলিয়াছেন, তাহাতে কিছু লোক বেজায় চটিয়াছেন, অনেকেই তুমুল আমোদ পাইয়াছেন। কিন্তু অনুমান, তাঁহার কথাকে লোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় নাই। তিনি সে জন্য লোককে দোষী করতে পারিবেন না, কারণ তিনি নিজেই কার্যত বলিয়াছেন যে, তাঁহার নাবালকত্ব এখনও ঘোচে নাই। নিজের কথার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তাঁহারই। সম্প্রতি যেমন বণিকসভায় প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলিলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্লথতার ফলে শিল্পায়নের বিপুল ক্ষতি হইতেছে। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্তের ব্যবস্থা করিবেন। প্রাকৃতিক সম্পদের সহিত জড়িত কোনও প্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘সিঙ্গল পারপাস ভেহিকল’ তৈরি করিয়া প্রথমে সব অনুমোদনের ব্যবস্থা করিয়া তাহার পর প্রকল্পটিকে নিলাম করিবার ব্যবস্থারও প্রতিশ্রুতি দিলেন রাহুল। প্রশাসনিক পঙ্গুত্বই যে সরকারের অভিজ্ঞান হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার প্রধান চালক দলের নেতার মুখে এমন প্রতিশ্রুতি অতি তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কথাকে কাজে পরিণত করিতে পারাই তাঁহার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের একমাত্র পথ।
রাহুল গাঁধী পারিবেন কি না, আগামী চার মাসে তাহার পরীক্ষা হইবে। কিন্তু, সংস্কারের প্রশ্নে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতার অভাবের একমাত্র কারণ রাহুল নহেন। ইউপিএ-র দশ বৎসরের ইতিহাসই তাহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতেছে। মনমোহন সিংহ ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার’-এর কথা যত বলিয়াছেন, কাজে তাহার অংশমাত্র করিয়া উঠিতে পারেন নাই। রাহুল তাঁহার ভাষণে শ্রম আইন সংস্কার এবং শিথিল শ্রম নীতি প্রবর্তনের কথা বলিয়াছেন। ভারতীয় অর্থনীতি যখন নিখুঁত নিশানায় গোল্লায় যাইতেছিল, তখনও মনমোহন এই কাজটি করিতে পারেন নাই। বিশ্বাসযোগ্যতা তো হাওয়ায় ফলিবে না। কিন্তু, কংগ্রেসের আরও বড় সমস্যা, তাহারা নীতি সংস্কার এবং প্রশাসনিক সংস্কারের বিভেদ করিয়া উঠিতে পারে নাই। নীতিগত সংস্কারের কাজ যতটুকুও বা হইয়াছে, প্রশাসনিক সংস্কার কিছুই হয় নাই। সরকারের পঙ্গুত্ব নীতিগত নহে, তাহা প্রশাসনিক। রাহুল তাঁহার ভাষণে সেই কথাটিই তুলিয়া আনিয়াছেন। সেই কারণেই তাঁহার বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাহার বাস্তবায়ন ভারতের পক্ষে জরুরি।
কয়লাখনি বণ্টন হইতে কোনও শিল্পের পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রদান, সবেতেই ইউপিএ সরকার ঠেকিয়া গিয়াছে। প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অতি কাম্য। পরিবেশের প্রশ্নেও কঠোরতা প্রয়োজন। কিন্তু সেই নীতিগত সতর্কতা বা কঠোরতার সহিত প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার কোনও সম্পর্ক নাই। সরকার কঠোর হইতেই পারে, কিন্তু সেই কঠোরতার শর্তগুলি ঠিক কী, তাহা পরিষ্কার ভাবে জানিতে এবং জানাইতে হইবে। সেই শর্ত মানিলে কাজ হইবে, নচেৎ নয়। কিন্তু শর্তগুলি মানা হইতেছে কি না, কোন পথে তাহা মানানো সম্ভব, এই প্রশাসনিক কাজগুলিতে অনিশ্চিতির কোনও অবকাশ নাই। ইউপিএ এখানেই আটকাইয়াছে। বস্তুত, প্রশাসনের সর্ব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি এবং অভিমুখহীনতা সরকারের অনেকগুলি নীতিগত সিদ্ধান্তের পথেও বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। রাহুল যদি এই প্রশাসনিক সংস্কারের কাজটি করিয়া উঠিতে পারেন, তবে লাভ বহুমুখী। তাঁহার অতীত বলিতেছে, ব্যর্থতার সম্ভাবনা বিপুল। নিজের অতীতের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া নিজেকে ভবিষ্যতের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন কি তিনি? |