আর্থিক সঙ্কটে জেরবার হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসকে বাঁচাতে ‘রাইটস শেয়ার’ ইস্যু করারই সিদ্ধান্ত নিল সংস্থার পরিচালন পর্ষদ।
মঙ্গলবার রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের দফতরে দু’ঘণ্টারও বেশি আলোচনার পর এ কথা জানান শিল্পমন্ত্রী তথা সংস্থার চেয়ারম্যান পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ধুঁকতে থাকা সংস্থাকে অক্সিজেন জোগানোর জন্য পুঁজির বন্দোবস্ত করতে এই পথই বেছে নিয়েছে পর্ষদ। সংস্থার বিআইএফআর (বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন)-এ যাওয়া আটকাতে এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলিও।
সংস্থা জানিয়েছে, ৫১ কোটি ২০ লক্ষ রাইটস শেয়ার অংশীদারদের আনুপাতিক হারে (প্রায় প্রতি ২.৯১টি ইক্যুইটি শেয়ারের জন্য একটি রাইটস শেয়ার) ইস্যু করা হবে। প্রতিটি শেয়ারের দর হবে ২৫.১০ টাকা। যা পেট্রোকেমের সরকারি শেয়ার নিলামের সময়ে দিতে চেয়েছিল একমাত্র দরদাতা ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসি)। পার্থবাবু জানান, পুরো প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি এখনও ঠিক হয়নি। তবে হাতে ৩০ দিন সময় আছে। আর্টিক্ল অব অ্যাসোসিয়েশন (সংস্থা পরিচালনার নীতি) মেনেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে বলে তাঁর দাবি। রাইটস শেয়ার ছাড়া হলে ১২৮৫.১২ কোটি টাকা তোলা সম্ভব হবে।
সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে পেট্রোকেম বিআইএফআরে গেলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার আর এক অন্যতম অংশীদার চ্যাটার্জি গোষ্ঠী। |
কারণ, সে ক্ষেত্রে স্রেফ রাজনৈতিক অঙ্কের বাইরে আর কিছু হারানোর থাকবে না রাজ্য সরকারের। সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের বক্তব্য, যুযুধান দু’পক্ষ এখনও যে-ভাবে দু’মেরুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাতে দ্রুত কোনও সমাধানসূত্র না-বেরোলে, সংস্থার বিআইএফআরে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে না-ও দাঁড়াতে পারে রাজ্য।
রাইটস শেয়ার ইস্যু করা নিয়ে অবশ্য এ দিন কোনও মন্তব্যই করতে চায়নি চ্যাটার্জি গোষ্ঠী। বরং গোষ্ঠীর কর্ণধার পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, সংস্থার স্বার্থেই টাকা সংস্থানের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা। যার মধ্যে রয়েছে আদালতের বাইরে সমস্যা মিটমাট করে নেওয়ার প্রস্তাবও। তবে এখনই সেই পরিকল্পনা বিশদে জানাতে রাজি হননি তিনি।
রাজ্য সরকারের বক্তব্য, সংস্থার মাথার উপর বিআইএফআরে যাওয়ার খাঁড়া ঝুলছে। চূড়ান্ত অর্থাভাবে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁচামাল কেনা। অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে কারখানায়। তার উপর আইনি জটে আটকে গিয়েছে আইওসি-র কাছে রাজ্য সরকারের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়া। এই পরিস্থিতিতে এখনই নতুন পুঁজি না-ঢাললে, কারখানা চালু রাখাই দায়। প্রায় অসম্ভব সংস্থার বিআইএফআরে যাওয়া আটকানোও। সেই কারণেই এ দিনের রাইটস শেয়ার ছাড়ার এই সিদ্ধান্ত।
পেট্রোকেমের দাবি, রাইটস শেয়ার ইস্যু করা সম্ভব হলে, চড়া সুদে ধার না-নিয়েও পুঁজির সংস্থান করা যাবে। তাতে কারখানা চালু রাখায় কিছুটা সুবিধা তো হবেই, উপরন্তু কিছুটা বাড়বে নিট সম্পদও। যা বিআইএফআর এড়ানোর ক্ষেত্রে উপযোগী হতে পারে। এ দিন সংস্থার জারি করা বিবৃতিতে পার্থবাবুর দাবি, নতুন করে আর কোনও আইনি জটিলতা তৈরি না-হলে, এর মাধ্যমে সংস্থাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। |
কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, সেই সম্ভাবনায় ফের বাধা হতে পারে আইনি জটিলতাই। কারণ, রাইটস শেয়ার ইস্যু করার মানে, ইতিমধ্যেই সংস্থার যা ইক্যুইটি শেয়ার রয়েছে, তার প্রতিটির জনু্য আনুপাতিক হারে নতুন শেয়ার আনা। ফলে যাঁর হাতেই ইক্যুইটি শেয়ার থাকুক না কেন, তিনি তার ভিত্তিতে রাইটস শেয়ার পাওয়ারও অধিকারী। ফলে যদি সব শেয়ারহোল্ডার তাঁদের প্রাপ্য রাইটস শেয়ার নেন, তা হলে সংস্থায় অংশীদারির সমীকরণ একই থাকার কথা। কিন্তু সংস্থার দাবি, কোনও অংশীদার ইচ্ছা করলে, তাঁর প্রাপ্য রাইটস শেয়ার না-নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তা যাবে আর এক অংশীদারের হাতে। তখন অংশীদারির ধরন বদলের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেই শেয়ার কেনা-বেচা কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি সংস্থা।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, অত সহজে পেট্রোকেমে অংশীদারির সমীকরণ বদল হওয়া শক্ত। কারণ, প্রথমত রাইটস শেয়ার বিক্রির বিভিন্ন নিয়ম রয়েছে। তার উপর মূল ইক্যুইটি শেয়ারের একটা অংশের মালিকানাই যেখানে বিতর্কিত, সেখানে তার ভিত্তিতে ইস্যু করা রাইটস শেয়ার মারফত অংশীদারি বিক্রি আদৌ কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
তাদের যুক্তি, যদি প্রতিটি ইক্যুইটি শেয়ারের জন্যই রাইটস শেয়ার প্রাপ্য হয়, তা হলে ওই নতুন শেয়ার ইস্যু করতে হবে বিতর্কিত ১৫.৫ কোটি শেয়ারের (যার মালিকানা দাবি করে রাজ্য সরকার ও চ্যাটার্জি গোষ্ঠী, দু’পক্ষই) জন্যও। কিন্তু ওই সাড়ে ১৫ কোটি শেয়ারের মালিকানা আদপে কার, তারই মীমাংসা হয়নি এখনও। ফলে এই পরিস্থিতিতে যদি ওই বিতর্কিত শেয়ারের ভিত্তিতে রাইটস ইস্যু করা হয়, তা হলে তার মালিকানা আবার কার উপর বর্তাবে, নতুন করে আইনি জটিলতা তৈরি হবে তা নিয়ে।
রাজ্য সরকারি সূত্রের দাবি, যাবতীয় আইনি জটিলতা সত্ত্বেও ওই সাড়ে ১৫ কোটি বিতর্কিত শেয়ার এখনও দেখানো আছে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের খাতাতেই। ফলে সে ক্ষেত্রে সরকার বলতে পারে, ওই শেয়ারের ভিত্তিতে ইস্যু করা রাইটস শেয়ার আপাতত কিনে নিচ্ছে তারা। পরে আদালতের রায় বিপক্ষে গেলে, বিতর্কিত সাড়ে ১৫ কোটি শেয়ারের পাশাপাশি তার ভিত্তিতে ইস্যু করা রাইটস শেয়ারও তুলে দেওয়া হবে ওই শেয়ারের প্রকৃত মালিকের হাতে।
অবশ্য কেউ কেউ মনে করছেন, এ সবের মধ্যেও আরও একটি সম্ভাবনা মাথাচাড়া দিচ্ছে রাইটস ইস্যুর দৌলতে। তা হল, যদি রাইটস শেয়ার ছাড়ার পর চ্যাটার্জি গোষ্ঠী তা না-নেয়, সে ক্ষেত্রে সংস্থায় তাদের অংশীদারি কমবে।
ফলে হলদিয়া পেট্রোকেমের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী আছে, তা বলবে একমাত্র সময়ই। |