সব ব্যবস্থা তাঁরা করে যাওয়া সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের আমলে কাটোয়ায় এখনও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠল না, মঙ্গলবার বর্ধমান শহরের জনসভায় দাবি করলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শিল্প থেকে কৃষি, বর্তমান সরকারের আমলে বর্ধমান জেলা সব কিছুতেই পিছিয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ করলেন তিনি।
এ দিন সভা ছিল বর্ধমান শহরে শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত আলমগঞ্জের হারাধানপল্লির মাঠে। ভিড়ে ঠাসা জনসভায় বুদ্ধদেববাবু বলেন, “শালবনিতে আমরা বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা করার চেষ্টা করেছিলাম। সিঙ্গুর থেকে ন্যানো গাড়ির কারখানা গুজরাতের সানন্দে চলে গেল। সেখানে নতুন উপনগরী গড়ে উঠেছে। কেন হয়েছে জানেন? ওই রাজ্য তো তৃণমূল নামে কোনও দল নেই! নিরুপম বর্ধমান জেলায় অনেকগুলি কারখানা তৈরিতে উদ্যোগ হয়েছিল। একটিও হয়নি।” এর পরেই কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রসঙ্গ তোলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি, “কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সব কিছু ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলাম। সেটাও হয়নি। পাঁচ বছরে রাজ্যে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র না গড়ে ওঠে, তাহলে পরে অবস্থা যে কী দাঁড়াবে, সহজেই অনুমেয়।” |
কাটোয়ার প্রকল্প নিয়ে অবশ্য বুদ্ধদেববাবুর দাবি মানতে চায়নি কংগ্রেস ও তৃণমূল। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বামফ্রন্ট যদি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সব ব্যবস্থা করেই যেত তবে পিডিসিএল-ই তো তা গড়ে ফেলত।” তাঁর অভিযোগ, “বামফ্রন্ট সরকার যথেষ্ট টাকার সংস্থান করে যায়নি। পরবর্তীকালে জমিদাতারা জমি দিতে ইচ্ছুক হলেও রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়েছে। ফলে প্রকল্পটির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।” রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী তথা আসানসোলের বিধায়ক মলয় ঘটকের দাবি, “বামফ্রন্টের আমলে শিল্পায়নের নামে গরিব চাষিদের জমি এক রকম গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমাদের নীতি, চাষিকে রক্ষা করা। কয়েকটি শিল্পে অধিগ্রহণ করা জমিতে সমস্যা দেখা দেয়। সেই সমস্যা মিটিয়েই আমরা শিল্পায়ন করব।” কাটোয়ার প্রকল্প নিয়ে বর্তমান সরকার উদাসীন, মানেননি তৃণমূলের জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি তথা রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথও। তিনি বলেন, “কয়েক দিন আগেই বিদ্যুৎমন্ত্রী এই প্রকল্প নিয়ে বৈঠক করেছেন।” সিঙ্গুর নিয়ে বুদ্ধবাবুর বক্তব্যের সমালোচনা করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “বুদ্ধবাবুর ভ্রান্ত জমিনীতির জন্যই আজ সিঙ্গুরের এই হাল।” |
শুধু শিল্প নয়, তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে কৃষিতেও বর্ধমান জেলার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বলে জনসভায় দাবি করেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “চাষিরা এখন চাষ করতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের ফসল কেনার কেউ নেই। যে বর্ধমান গোটা রাজ্যকে ভাত খাওয়াত, সেখানেও ধান চাষ কমছে। চাষে বিপর্যয়ের কারণে চাষিরা আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু সরকার তা মানতে না চেয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।” বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মলয়বাবুর অবশ্য দাবি, “চাষিমৃত্যুর ঘটনাগুলিতে আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কোনওটি চাষে বিপর্যয়ের কারণে নয়।” তৃণমূল নেতা স্বপনবাবুর বক্তব্য, “আমরা চাষিদের সুরক্ষার দিকে সব সময়ে নজর দিই। বর্ধমানে ধান চাষ কমেছে এমন কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। বরং, উল্টো খবরই রয়েছে।”
২০০৮ সালে বর্ধমানের ২৭৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ২০২টি দখল করেছিল বামেরা। সেখানে গত পঞ্চায়েত ভোটের পরে এখন মাত্র ৪২টিতে ক্ষমতায় রয়েছে তারা। বুদ্ধদেববাবু এ দিন দাবি করেন, তৃণমূলের হাতে পড়ে তাঁদের তিল তিল করে গড়ে তোলা পঞ্চায়েতের সর্বনাশ হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, “গরিব মানুষ আর পঞ্চায়েতে ঢুকতে পারেন না।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদার অভিযোগ করেন, গত আড়াই বছরে তাঁদের মোট ১৫ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। ৭৩৪৮ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৭৫৬ জনকে জেলে যেতে হয়েছিল। কোথাও তাঁদের অফিস খুলতে বা সভা-সমিতি করতে দেওয়া হচ্ছে না। বুদ্ধদেববাবুরও দাবি, “আমরা টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। কিন্তু কোথাও বিরোধী দলের অফিস ভাঙচুর হয়নি। ওদের কাউকে গ্রেফতার করিনি।”
বুদ্ধদেববাবুদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে তৃণমূলের বর্ধমানের অন্যতম পর্যবেক্ষক অলোক দাসের বক্তব্য, “এক সময়ে সিপিএমের কার্যালয়গুলিতে মানুষকে ডেকে বিচারের নামে মারধর করা হত। ওদের আমলে আমাদেরই সভা-সমিতি করার উপায় ছিল না। চায়ের দোকানে বসেও কেউ রাজনীতির আলোচনা করতে পারতেন না। তাই পরিবর্তনের পরে সিপিএম অফিস খুলতে ভরসা পাচ্ছে না।” |