|
|
|
|
ও কবিতাওয়ালা |
বাংলা ছবির জনপ্রিয় গীতিকার এখন তিনি। এ বার শান্তনু মৈত্রর হিন্দি অ্যালবামের জন্য গান লিখছেন।
এ সবের মধ্যে কি আড়ালে চলে যাচ্ছে তাঁর কবিসত্তা? অকপট শ্রীজাত। মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত। |
আপনি হিন্দিতে গান লিখেছেন শান্তনু মৈত্রর জন্য? হ্যা।ঁ ন্যাশনাল অ্যালবাম করছে শান্তনু। এর আগে আমি সিনেমার জন্য হিন্দিতে গান লিখেছি। ‘অটোগ্রাফ’-এর জন্য লিখেছিলাম ‘আগে যানা হ্যায় কঁহা’। ‘ইতি মৃণালিনী’-র গানগুলোর হিন্দি অনুবাদ আমি করেছিলাম। তার মধ্যে সুনীলদার ‘স্মৃতির শহর’টাও ছিল। ‘গয়নার বাক্স’তে দেহাতি হিন্দিতে একটা গান লিখেছিলাম। ‘মিশর রহস্য’-র ‘দিল্লি’ গানটা আমার লেখা। অরিজিৎ সিংহ গেয়েছিল।
এই অ্যালবামের গানগুলো কেমন? যাঁরা কাজ করবেন এই অ্যালবামে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পণ্ডিত রাজন-সাজন মিশ্র, পরভীন সুলতানা, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, বালমুরলিকৃষ্ণজি। এ ভাবে বেসিক অ্যালবামে এই দিকপালরা গাননি কোনও দিন। তবে ‘অটোগ্রাফ’ বা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর গানের মতো হবে না। এই শিল্পীদের গ্রেস আর ব্যাকগ্রাউন্ডটা মাথায় রেখে গানগুলো লিখব। সিম্পল লিরিকস। কোনও থিম দেওয়া হয়নি আমাকে। শান্তনু বলেছে যদি ২০১৩ সালে একজন কবি ঠুংরি লেখে, সেটা ভেবে তুই কথাগুলো লিখিস। শান্তনু সুর আগে করছে। তার পর আমি কথা লিখব।
এখন বেশির ভাগ জনপ্রিয় বাংলা গানে ‘মাহি ভে’, ‘সোনিয়ো’ ধরনের শব্দ ব্যবহার হয়। আপনার তা পছন্দ? উর্দুঘেঁষা হিন্দি ব্যবহার করতে বললে আমার অসুবিধে নেই। কিন্তু কোনও শব্দকে আমি জোর করে বসাতে চাই না। আমি তো ‘জ্যোৎস্নায় মোড়া প্লাস্টিক’ কথাগুলো লিখেছিলাম। কিন্তু এই রকম শব্দের ব্যবহারে আমি কোনও গা-জোয়ারি দেখাইনি।
কেতাদুরস্ত হবে বলে শব্দের ব্যবহারে কি ভাষার ক্ষতি হচ্ছে? ভাষার কিছুতেই ক্ষতি হবে না। আরও একটা কথা আছে। এই সব শব্দ ব্যবহার করা গানেরও শ্রোতা আছেন। বাট দ্যাট ইজ নট মাই কাপ অব টি।
আপনার কবিতার বই প্রকাশ হচ্ছে আবার। কিন্তু আপনি বলেন যে এখনকার অনেকেই নাকি জানেন না যে আপনি কবিতা লেখেন! হ্যাঁ, এটা ঠিক। ১৭টা বই আছে আমার। এটা ১৮-তম বই। আমি এ বার সাবালক হলাম (হাসি)। একদিন ঝুপড়ির দোকানে বসে চা খাচ্ছি যখন শঙ্খবাবু আমাকে বলেন একটা পত্রিকার জন্য আটটা কবিতা দিতে। এক মাস সময় দিয়েছিলেন আমাকে। আমি পাঁচ দিন ঘরবন্দি হয়ে ৬০-টা কবিতা লিখে ফেলি। সেখানে আমার ক্রোধ এবং হতাশার কথা ফুটে বেরোয়। বইটার নাম ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’। এই বইয়ের বেশির ভাগ কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। সেগুলো পড়ে যোগেন চৌধুরী তাঁর ভাল লাগার কথা মুক্ত কণ্ঠে জানান। তখন ওঁকে বলি যদি এটা বই আকারে বেরোয়, তা হলে উনি কি আমায় প্রচ্ছদটা এঁকে দেবেন? যোগেনদা বইটার জন্য একটা ফ্যাবিউলাস কভার এঁকে দিয়েছেন। বইমেলাতে বইটা আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করবে।
কবিতাগুলোর মধ্যে আপনার এক রাগী, ক্ষুব্ধ সত্তা প্রকাশ পেয়েছে... হ্যা।ঁ আমি বিশ্বাস করি বিপ্লবের দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। ক্রান্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। কর্কটের ওষুধ মেলেনি। আমাদের কারও মেরুদণ্ড নেই। যা আছে, তা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট। শীতঘুম মার্কা সাপের জীবনযাপন করছি সবাই। যত ক্ষণ না আমার ল্যাজে পা পড়বে, আমরা কিছুই বলব না। আর তখনই বলব যখন আমি নিশ্চিত থাকব যে আরও বড় পা পড়বে না।
গানের জনপ্রিয়তার কারণেই হয়তো আপনার কবি সত্তাটা একটু ঢেকে যাচ্ছে। এটা ভাবলে কেমন লাগে? গানের শ্রোতার সংখ্যা কবিতার পাঠকের থেকে বেশি। তবে এ সবের মধ্যেও অনেক পাঠকের মুখোমুখি হয়েছি। ভালবাসা থেকে গান লিখি। ছোটবেলা থেকে বাড়িতে গানের চর্চা ছিল। তারাপদ চক্রবর্তী আমার দাদু। তবে কবিতা তো আমার অনেক বেশি প্রেমের জায়গা। আমি আশুতোষ কলেজে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে পড়তে গিয়েও পরীক্ষার আগের দিন সকালে বিহারে চলে গিয়েছিলাম। অনার্সটা পাস করা হয়নি। তবে ফিরেছিলাম দু’ডায়েরি ভর্তি কবিতা লিখে। কবিতার ওপর পর্দা পড়লে অভিমান হয় বেশি, কারণ কবিসত্তার গায়ে আঘাত লাগুক তা আমি চাই না। একজন কবি শেষ জীবন পর্যন্ত কবি হয়ে পরিচিত থাকতে চায়।
অনুপম রায়-এর লেখা কেমন লাগে? ওর লেখার মধ্যে খুব বেশি কবিতা খুঁজে পাই। ওই যে লাইনটা লিখেছিল ‘আমি ও বেলার ডাল-ভাতে ফুরিয়ে গিয়েছি’ তাতে কী সুন্দর ‘ও বেলার ডাল-ভাত’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছে!
গীতিকার, সুরকার না গায়ক অনুপমের কোন সত্তাকে এগিয়ে রাখবেন? গীতিকার, তার পর সুরকার, গায়ক। |
সেরা তিন |
|
|
|
চল রাস্তায়
‘অটোগ্রাফ’ |
দিল্লি
‘মিশর রহস্য’ |
পত্তো কা হ্যয়
চ্যাপলিন |
|
কোনও প্রযোজক আপনাকে জোর দিয়ে বলেছেন ও ভাবে নয়, এ ভাবে লিখুন, কারণ এটার ‘বাজার আছে’? না। তারাই আমাকে অ্যাপ্রোচ করেন, যাঁরা আমার লেখাটা চান। আমাকে এসেই বলেন যে ‘সো কলড্ পোয়েটিক’ কিছু চাইছি। কিন্তু সেটা যেন সরল ভাষায় লেখা হয়। সরল আর তরলের মধ্যে তফাত রয়েছে। আমার সারল্যে আপত্তি নেই। তারল্যে আপত্তি আছে। যে জায়গাগুলোয় আমার লিমিটেশনস আছে, সেটা লেখার জন্য অন্য মানুষ রয়েছেন।
গুলজার সাব কবি হয়েও ‘বিড়ি জ্বলাইলে’ লিখেছেন... হ্যা।ঁ তবে দ্বিতীয় লাইনটা দেখুন। ‘বিড়ি জ্বলাইলে/ জিগর সে পিয়া’। উনি বলছেন হৃদয়ের আগুন দিয়ে বিড়ি জ্বালানোর কথা। এটা একমাত্র একজন কবির পক্ষেই লেখা সম্ভব। কোনও রুচিকে আহত করেনি। আমি বিশ্বাস করি না সব সময় ভাবগম্ভীর হয়েথাকব। বীরসা দাশগুপ্তর ‘অভিশপ্ত নাইটি’-তে একটা নাইটিকে নিয়ে গান লিখেছি আমি। তবে কথাগুলো বলতে পারব না।
নিজে লিখেছেন, কিন্তু কথা মনে নেই? না। নেই। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই।
মানে? পরপর গান বললে চিনতে পারবেন কোনটা আপনার লেখা? আমার লেখার স্টাইলটা আমার জানা।
তবে গড়গড় করে গোটা গানটা বলতে পারব না।
‘যাও পাখি’ গানটা কার লেখা? অনিন্দ্য, চন্দ্রিল...
‘চল রাস্তায়’... এটা আমার লেখা। গানটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে।
‘টিপটিপিয়ে অঝোর ধারা’... জানি না।
আপনার লেখা ‘আজব প্রেম এবং’ ফিল্মে বৃ্ষ্টির গানটা লিখেছিলেন... আমার গান আমার কাছে এত ইম্পর্ট্যান্ট নয় যে আমি মনে রাখব। কিন্তু মির্জা গালিব, জগজিৎ সিংহের গজল বলুন, এখনই বলে দেব।
অদ্ভুত তো! বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কবীর সুমন লিখেছেন। সেখানে আমাদের লেখা লোকে পড়ছে, শুনছে, সেটাই তো বড় প্রাপ্তি। ওঁদের গানবাজনা যদি বিয়েবাড়ির ফুলকোর্স মেনু হয়, আমরা নুন-লেবুও নই। দুঃখের বিষয়, এটা অনেকেই ভুলতে শুরু করেছেন। দেয়ার ইজ অ্যান ওভারহোয়েল্মিং সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট। একটা আত্মতৃপ্তি। নিজের বিজ্ঞাপন নিজেই করা। এই ট্রেন্ডটা আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না যে, যে করে হোক টিকে থাকতে হবে। নাম করতে হবে। আমি পুরনোপন্থী।
আপনাকে কেউ ঠাট্টা করে বিনয়বাবু বলে সম্বোধন করেছেন? আমি উদ্ধত হলে তো শঙ্খবাবুর টাওয়ারে বসে থাকা উচিত। লোকজনের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আসলে এই জিনিসটা এত রেয়ার যে, নিজের লেখাকে ছোট বললে এখন লোকে বিনয় ভাবে।
দমবন্ধ লাগে? এখনও না। আমার নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। আর কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা আমায় বোঝেন।
যাঁরা আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন, সেই সহকর্মীদের তা মনে করান? না। নিজেকে কী ভাবে প্রজেক্ট করবে, সেটা তাঁর পার্সোনাল ব্যাপার। পদে পদে আমি সেল্ফ অ্যাসেস করা লোক। আমি নিজের লিমিটেশনটা বুঝি।
সেটা কী? আমি কবিতা আর গানের ক্ষেত্রে খুব আর্বান। আমি ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ লিখতে পারব না। আমি গ্রামে একটা রাতও কাটাইনি।
কিন্তু আমার ঘাম-রক্ত দিয়ে শহরটাকে চিনি। সে আমার প্রেমিকার মতো। গ্রামকে আমি সুদূরের মিনারের মতো দেখি।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো আফ্রিকাতে না গিয়েই ‘চাঁদের পাহাড়’ লিখেছিলেন। কোনও রকম তুলনা না করেই বলছি, কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতে চান না? গদ্য লিখলে সেটা হত। কবিতা আর গানের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো আমি পারব না।
বাংলা সিনেমার বাজেট বেড়েছে। শুধুমাত্র গীতিকার হয়ে কি জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব? না। তা ছাড়া আমি মনে করি নিজের প্যাশনকে রুজি করতে নেই। |
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
|
|
|
|
|