সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় ধানের বাজারদর এখন বেশি হওয়ায় রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় শিবির করেও তেমন সাড়া মিলছে না। চাষিরা বরং চালকল মালিকদের অপেক্ষাকৃত বেশি দামে ধান বিক্রি করছেন।
চলতি মরসুমে রাজ্য সরকার কুইন্ট্যাল প্রতি ধানের দর স্থির করেছে ১৩১০ টাকা। যদিও চাষিরা সরাসরি চালকল মালিকদের ওই পরিমাণ ধান দিচ্ছেন ১৩৫০ টাকায়। স্বভাবতই মিল মালিকদের কাছে ধান বিক্রিতে উৎসাহ বেশি। এই প্রবণতার পিছনে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অস্বাভাবিকতা দেখছেন না। তিনি বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য, চাষিকে যেন ধানের অভাবী বিক্রি করতে না হয়। চাষির জন্য সরকার। কোথাও যদি চাষিরা সরকার নির্ধারিত দামের কমে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন, সে ক্ষেত্রে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।”
বিগত বছরগুলিতে রাজ্যে ধানের দাম নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় আলু ও ধানের অভাবী বিক্রির অভিযোগও উঠেছে। গত মরসুমে ধানের সহায়ক মূল্য ছিল কুইন্ট্যাল পিছু ১২৫০ টাকা। সরকার এ বার সেই দর বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। বর্ধমান জেলা চালকল মালিক সমিতি অবশ্য জানায়, প্রতি বারই প্রথমে ধান কেনা শুরু করে চালকল। পরিকাঠামো তৈরি করে ধান কিনতে নামতে সরকারের কিছুটা সময় লাগে। |
সরকারি সূত্রের খবর, চলতি মরসুমে রাজ্যে ১৫০ লক্ষ মেট্রিক টন ধান হয়েছে। সরকার রাজ্যের চালকলগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে, অন্তত ৮ লক্ষ মেট্রিক টন লেভির ধান সরকারকে কিনে দিতে হবে। এই সিদ্ধান্তে রাজ্যের চালকল মালিকরা খুশি নন। কারণ, এখন বাজারদর অনুযায়ী তাঁদের কুইন্ট্যাল পিছু ৪০ টাকার বেশি দরে চাষিদের থেকে ধান কিনতে হচ্ছে। চালকল মালিকদের দাবি, ধানের বাজার ক্রমশই আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। বাজারদর যত বাড়বে, লেভির ধান কিনতে ততই তাঁদের পকেটে টান পড়বে। সরকার অবশ্য চালকল মালিকদের সেই যুক্তি মানতে নারাজ। খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “রাজ্যে লেভি বাদেও ৭৮ লক্ষ মেট্রিক টন চাল রয়েছে তাঁদের ব্যবসার জন্য। তা তাঁরা বাংলাদেশ, মায়ানমার বা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে পাঠাতে পারেন। রাজ্য সরকার অনুমতি দিতে তৈরি। কিন্তু চাষিদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কোনও কাজ আমরা করব না।”
মন্ত্রী যাই বলুন, বাজার চলতি দামে রাজ্যের চাষিরা আদৌ খুশি হচ্ছেন কি না, জেলায় জেলায় সেই প্রশ্ন উঠছে। দক্ষিণবঙ্গের বর্ধমান বা হুগলি থেকে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার সর্বত্র ছবিটা মোটামুটি একই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কোচবিহারের নিশিগঞ্জে ধান কেনার জন্য সরকারি শিবির হলেও চাষিরা ধান নিয়ে আসেননি। নিশিগঞ্জ, দিনহাটার আলোকঝাড়ি ও কোচবিহার সদরে চকচকা এলাকায় তিনটি চালকলেও সরাসরি সহায়ক মূল্যে ধান কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানেও ধান বিক্রিতে সাড়া নেই। কোচবিহারের খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের জেলা নিয়ামক মানিক সরকার বলেন, “চাষিরা ভাল দাম পাচ্ছেন, এটাই বড় কথা। তবে ধান কেনার জন্য জেলা জুড়ে শিবির হচ্ছে।” দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রানা গোস্বামী বলেন, “সহায়ক মূল্যের চেয়ে বেশি দামে খোলা বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে। জেলায় ধানের উৎপাদন খানিকটা মার খাওয়ায় বাজারে চাহিদা ও দাম দু’টোই বেড়েছে। চালের দাম বাড়ার আশঙ্কাও থাকছে।”
ঘুঘুমারির চাষি নন্দ বর্মন বলেন, “নয় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। গড়ে ৬ মণ ফলন পেয়েছি। অন্য বার গড়ে বিঘা প্রতি ৮ মনের বেশি পেলেও এ বার তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন কমেছে। খোলা বাজারে ১৪০০ টাকা কুইন্ট্যাল দরে ধান বিক্রি করেছি। সহায়ক মূল্য কম বলে সরকারি শিবিরে যাইনি। তবে ফলন কম হওয়ায় আখেরে লাভ হল না।” হুগলির বিভিন্ন জায়গায় সরকারি শিবির হয়ে গিয়েছে। এখানেও শিবিরের তুলনায় চালকলে ধান বিক্রিতে উৎসাহ অনেক বেশি। জেলা কৃষি দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “চাষিরা কাকে ধান দিচ্ছেন তা বড় নয়, ভাল দাম পাচ্ছেন সেটাই বাস্তব।” |