শীত পড়ুক না পড়ুক, শহর আজ উৎসবের। যার মধ্যমণি ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি। সান্তা, কেক, কুকিজ, সার্কাস, কমলালেবুর মরসুমেও সপ্তাহ শুরুর দিনে দাপটে যা রাজত্ব করে গেল ময়দানে।
উৎসবের নেপথ্য নায়ক আবার উড়ে এসেছেন ৮১৪১ নটিক্যাল মাইল পেরিয়ে। দুই মহাসাগর (অতলান্তিক এবং ভারত মহাসাগর) টপকে। নাতি দিয়েগোর হাত ধরে। তিনি সত্তরের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো তোরেস।
এই বিশ্বকাপ আর কার্লোস দেখতেই সোমবার পুলিশ মাঠে উপচে পড়ল আট থেকে আশির ভিড়। রাত ন’টার হিসেব বলছে, এ দিন বিশ্বকাপ দর্শন করেছেন প্রায় এগারো হাজারের মতো দর্শক। ভিক্টোরিয়া, নলবন, মিলেনিয়াম পার্ক ছেড়ে তরুণ-তরুণীরাও সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা—বারো ঘণ্টার ফুটবল কার্নিভ্যালের আঁচে পুরোদমে সেঁকে নিলেন নিজেদের। বিশ্বকাপের পাশে দাঁড়িয়ে হাসি-হাসি মুখে ছবি তুলে বাড়ি ফিরল বজবজের সন্দীপ, বর্ধমানের ক্যামেলিয়ারা। সঙ্গে উপরি বিশ্বকাপে প্রিয় দলের ট্যাটু, জিওফ হার্স্ট থেকে রোনাল্ডো-জিদান হয়ে ইনিয়েস্তাদের কাপ জয়ের দেড় মিনিটের ঝলক। নাচাগানার সঙ্গে অবিশ্বাস্য ফুটবল জাগলিং দর্শন। শেষ বেলায় ইডেনের কোল ঘেঁষে সূর্য যখন অস্তাচলে তখন আবার হাজির ২০১৪ বিশ্বকাপের আর্মাডিলো ম্যাসকট ‘ফুলেকো’। ট্রফির সামনে দাঁড়িয়ে কার্লোসের সঙ্গে তাঁর করমর্দন দেখার জন্য সাপের মতো এঁকেবেঁকে লম্বা লাইন পুলিশ মাঠের চারধারে। যা মনে করাচ্ছিল ষাট-সত্তর দশকের ময়দানকে। সই শিকারিদের খাতায় পটাপট উঠল বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে ‘প্রেসিডেন্ট’স গোল’ করা কার্লোসের অটোগ্রাফও। |
কী সেই প্রেসিডেন্ট’স গোল? কার্লোস বললেন, “সে বার (সত্তরের) বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন সকালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট মেক্সিকো সিটিতে পা দিয়েই বলে দিয়েছিলেন কাপ জিতবে ব্রাজিল। ফল হবে ৪-১। শেষ গোল করব আমি। সেটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।”
বিশ্ব ফুটবলে এখন ধুন্ধুমার চলছে ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে। সদ্য যেই বিতর্ক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে ইতালির গাত্তুসোকেও। এখন সেই ‘প্রেসিডেন্ট’স গোল’ করলে গড়াপেটা বিতর্ক কি তাড়া করতে পারত? শুনে হেসে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন কার্লোস। ততক্ষণে নাতি দিয়েগোর প্রশ্ন নাড়িয়ে দিয়ে গেল, “এত লোক, এত আগ্রহ, আপনারা বিশ্বকাপ ক্রিকেট, হকি ঘরে তুলেছেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের ট্রফিটাও চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই এক দিন পাবেন।”
কী ভাবে? সাত সকালেই বাইপাসের ধারে সাত তারা হোটেলে রোড ম্যাপ দিয়ে এসেছেন দিয়োগোর ঠাকুর্দা কার্লোস। যা শুনলে আহ্লাদিত হতে পারতেন নইমুদ্দিন, মার্কোস ফালোপারা।
কেন? ভারতীয় ফুটবলের উৎকর্ষ বাড়াতে বছর অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলার অভিজিৎ সরকার, জিতেন্দ্র সিংহদের জন্য কার্লোসের উপদেশ, “পরিশ্রম, পরিশ্রম আর পরিশ্রম। কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। মেসি থেকে নেইমার এই কঠোর পরিশ্রম করেই আজ এত সফল। সাফল্যের সহজ রাস্তা নেই। ব্রাজিলে দশ বছরের বাচ্চারা পরিশ্রমে ঢিলে দেয় না বলেই একের পর এক তারকা ফুটবলার বেরোয়।”
পেলেদের জুলে রিমে কাপ চিরতরে রিওতে নিয়ে যাওয়ার ক্যাপ্টেন তার কারণও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, “চার বছর পরে এদেশে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের আসর বসবে। তার জন্য এখন থেকেই খুদে ফুটবলারদের বোঝাতে হবে, পরিশ্রমের মাহাত্ম্য। ড্রিবল করতে তো সবাই পারে। কিন্তু ঠিক মতো পাস বাড়াতে হবে তো!” তাই জিতেন্দ্রদের পরম স্নেহে মঞ্চে ডেকে নিয়ে ৬৯ বছরের ব্রাজিলীয় বললেন, “বলটাকে বালিশ বানিয়ে ঘুমোতে যাও। আর মনে মনে বল, আমাকে ফুটবলার হতেই হবে। আমিও পনেরো বছর বয়সে এ ভাবেই আমার বাবাকে বুঝিয়েছিলাম আমি ফুটবলার হতে চাই।”
আর অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য বললেন, “প্রয়োজনে ব্রাজিল থেকে খুদে ফুটবলারদের ব্যাকরণ শেখানোর জন্য কোচ-ফুটবলার আদানপ্রদান হোক না। তবে ভারতীয়রা নিজেদের ছন্দেই যেন খেলে।”
পেলের অধিনায়কের কথা মনে ধরেছে ফেডারেশনেরও। কয়েকদিনের মধ্যেই পাঁচ ফুটবলারকে ব্রাজিলে প্রস্তুতি নিতে পাঠাচ্ছেন তাঁরা। যার মধ্যে রয়েছে বাংলার অভিজিৎ, জিতেন্দ্ররাও।
|