|
|
|
|
শহরে শীতের অতিথি: কাপ-মোহনায় মিশল ফুটবল ও ক্রিকেট |
ভারতীয় ফুটবলের বিশ্বকাপ-মডেল দিয়ে গেলেন সচিন
রতন চক্রবর্তী ও রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি, দেশের ‘ভারতরত্ন’। বিশ্বকাপ তিনিও ছুঁয়েছেন, তুলেছেন, কিন্তু আঠারো ক্যারটের সোনার ট্রফি এক ফুট দূরত্বে থেকেও ছোঁয়া হল না।
নিয়ম নেই যে!
সচিন তেন্ডুলকরের কি আফসোস হচ্ছে?
সঞ্চালকের প্রশ্নে অল্প কিছুক্ষণ চুপ। জীবনে এমন মুহূর্ত তাঁর খুব কমই এসেছে যেখানে তিনি কাঙ্খিত বস্তু চেয়ে পাননি। সচিন জানেন সেটা, স্বীকারও করলেন। রবিবাসরীয় কলকাতা সে দিক থেকে তাঁর কাছে ব্যতিক্রমী দিন নিশ্চয়ই। যে দিন তাঁর চোখের সামনে ফিফা বিশ্বকাপ থাকল, সত্তরের পেলের বিশ্বজয়ী ব্রাজিল টিমের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো তোরেস থাকলেন, ক্রিকেট কেরিয়ারের দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থাকলেনকিন্তু এত কাছে থেকেও কাপ দূরেই থেকে গেল!
“এটা ঠিক যে এ রকম খুব কমই হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে এটাও বলব যে, ছোটবেলা যে জিনিসটা আমি ধরতে চেয়েছি, হাতে তুলতে চেয়েছি, যার জন্য ক্রিকেটটা খেলেছি, সেটা হয়েছে। ক্রিকেট বিশ্বকাপ ছোঁয়াটা জীবনের স্পেশ্যাল মুহূর্ত। তাই বাকি কোনও কিছুর জন্য আমার আফসোস নেই,” সঞ্চালকের ‘বাউন্সারে’ পাল্টা ‘হুক’ করতে সময় লাগল মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ফুটবলের দুই মহাকর্তার সামনে এমন কিছু মণিমাণিক্য দিয়ে গেলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর, যা মেনে চললে লাভ আছে। ক্ষতি নেই। চার বছর পরে দেশের মাটিতে যুব-বিশ্বকাপ। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব তো বটেই, এমনকী ফুটবল মহলের বিশ্বাস তার প্রভাবে দেশজ ফুটবলের কাঠামোতেই আমূল পরিবর্তন দেখা যাবে। কিন্তু কী ভাবে সে দিকে এগোনো উচিত? সচিনের মন্ত্র এ রকম: |

ফুটবল বিশ্বকাপের প্রচারে ক্রিকেট তারকারা। রবিবার শহরে এল ফিফা বিশ্বকাপ। সেই উপলক্ষে
এক অনুষ্ঠানে সচিন, সৌরভ। সঙ্গে ১৯৭০-এ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো। |
এক) সঠিক লোককে নিয়ে আসতে হবে বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে। যারা একদম গ্রাসরুট পর্যায় থেকে ফুটবলারদের পরিচর্যা করবে।
দুই) বিশ্ব ফুটবলের মহাশক্তিদের ‘প্রোফেশনাল আউটলুক’-টা আমদানি করা দরকার। অর্থাৎ, লাতিন আমেরিকা বা ইউরোপীয় দেশগুলো যে পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করে, যে ধরনের সাপোর্ট স্টাফের ব্যবস্থা করেভারতীয় ফুটবলেও এ বার থেকে সে সব থাকা দরকার।
তিন) প্রথমেই বাকিদের সঙ্গে জেতার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। বরং প্রথম ধাপ থেকে নিজেদের তৈরি করার দিকে মন দেওয়া ভাল। তবেই উপরে ওঠা যাবে। রেজাল্ট নয়, প্রসেসে মন দেওয়া বেশি জরুরি।
“বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ জীবনে একবারই হয়। এবং এটা একটা টুর্নামেন্ট নয়, সফর,” বলছিলেন সচিন। যিনি বছরখানেক আগে মুম্বইয়ে স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যান খুদে ফুটবলারদের মানসিকতা দেখে। “ওদের দেখেছিলাম ট্রফিটা জেতার জন্য কী ভাবে মরণপণ লড়ে যাচ্ছে। পাশে বসা সুনীল ছেত্রীকে সেটা বলেওছিলাম।”
বিশ্বের নব্বইটা দেশের দর্শকদের বিশ্বকাপ দেখানোর ব্যবস্থা করেছে কোকাকোলা। কাঠামান্ডু থেকে এ দিনই কলকাতায় ট্রফি নিয়ে এলেন ফেডারশন সচিব কুশল দাস। যে ট্রফি-উন্মোচনের রোশনাই বাড়াতে উদ্যোক্তারা নিয়ে আসেন সচিন-সৌরভকে। যা কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্বজয়ী দলের অধিনায়ক ছাড়া কারও ছোঁয়ার নিয়ম নেই। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্রাজিল টিমের ক্যাপ্টেন কার্লোস যখন সোনার ঝকঝকে ট্রফিটা নিয়ে পাঁচতারা হোটেলের বলরুমের মঞ্চে ঢুকছেন, তুমুল হর্ষধ্বনি এবং হাততালির ঝড় মিলে এমন সমুদ্রগর্জন সৃষ্টি করল যে মনে হবে, ব্রাজিল বিশ্বকাপের বোধন বোধহয় কলকাতাতেই হয়ে গেল! সৌরভ ততক্ষণে আবেগাপ্লুত। ’৮৬ বিশ্বকাপের দিয়েগো মারাদোনার গোলের বর্ণনা এমন ভাবে তুলে আনছেন, শুনলে মনে ম্যাচটা বুঝি তাঁর সামনে লাইভ চলছে!
“আমি কার্লোসকে একটা কথা বলতে চাই। ব্রাজিল যদি বিশ্বফুটবলের হৃদয় হয়, কলকাতা ভারতীয় ফুটবলের,” ‘দাদা’-র কথা শুনে প্রৌঢ় কার্লোসের ঠোঁটে মুচকি হাসি। পাল্টাটা তিনি দিলেন, গোটা কলকাতাকে ব্রাজিল বিশ্বকাপ দেখতে আসার নিমন্ত্রণ করে! শুনে সৌরভ আবার শুরু করলেন, “সচিনের মতো আমি ছোট থেকে ব্যাট ধরিনি। পরে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছি। ছোটবেলায় স্কুল শেষ হলেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল র্যাম্পার্টে দৌড়তাম।” সচিন ভারতরত্ন পাওয়ার পর মুম্বই মহানায়ককে যিনি এ দিনই প্রথম দেখলেন। যিনি ক্রিকেট কমেন্ট্রির ফাঁকে বিশ্ব ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন নিয়মিত। যিনি মনে করেন, নেইমার একাই ব্রাজিল বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে দেবেন। আশা করেন, ২০১৭ যুব বিশ্বকাপের পর দেশের খুদেদের মননে শুধু ক্রিকেট নয়, ফুটবলও থাকবে। যিনি আফসোসে ভুগছেন রিও বিশ্বকাপের টিকিট থাকা সত্ত্বেও যাওয়া হবে না বলে। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের টিকিট ছিল, কিন্তু বোনের বিয়ে থাকায় যাওয়া হয়নি সৌরভের। ব্রাজিল বিশ্বকাপের দু’টো টিকিট আছে। কিন্তু এ বারও স্টেডিয়ামে বসে বিশ্বকাপ ম্যাচ প্রত্যক্ষ করা হবে না। তখন ট্রেন্টব্রিজ টেস্ট চলবে যে। |

কাপের সামনে কিংবদন্তি। ছোঁয়া গেল না,দেখেই তৃপ্ত থাকতে হল। রবিবার শহরে। |
রঙিন আবহ দেখলে স্বপ্নের মতো মনে হবে। যা আদতে ভুল। কারণবরাবরের মতো বিতর্কও থাকছে।
ফুটবল ও ক্রিকেটের তিন সুপার-চ্যাম্পিয়নকে যেমন আজকের আগে কখনও দেখেনি কলকাতা, ঠিক তেমনই আজ দেখল কী ভাবে ফুটবলের মঞ্চে গৌণ হয়ে পড়ল খোদ ফুটবলই! মঞ্চে এ দিন তোলা হয়নি কোনও প্রাক্তন বা বর্তমান ভারতীয় ফুটবলারকে। অথচ, চুনী গোস্বামী ছিলেন। বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। ’৭৭-এ কসমস ম্যাচের ছবি সঙ্গে নিয়ে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। কিন্তু কাউকেই মঞ্চে ডাকা হল না। ভাইচুং ভুটিয়াও নেই। নেই সুনীল ছেত্রীরাও।
যা নিয়ে ক্ষুব্ধ ফেডারেশন কর্তারা। ভাইস প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্ত বললেন, “এটা ঠিক হয়নি। ফুটবল বিশ্বকাপ, অথচ মঞ্চে ফুটবলাররা নেই, এটা ভাল দেখায় না।” আর চুনী বললেন, “আপনারা দেখেছেন কী হয়েছে। আমি কিছু দেখিনি।” ফুটবলারদের না তুললেও মঞ্চে মন্ত্রী-মেয়র হাজির ছিলেন। কার্লোস তোরেসকে গুলিয়ে ফেলা হল রবার্তো কার্লোসের সঙ্গে! ফিফা বিশ্বকাপকে অনায়াসে বলে ফেলা হল জুলে রিমে কাপ। যা শুনে কার্লোসও ভ্রু কুঁচকোলেন। কারণওটা বহু দিন আগে চুরি গিয়েছে!
তবু বিশ্বকাপকে ঘিরে আবেগকে দেখলে, আগামী তিন দিনের উৎসবের কথা ভাবলে এগুলো বোধহয় ভুলে যাওয়া যায়। কোকাকোলার ডেপুটি প্রেসিডেন্ট বেঙ্কটেশ কিনি বলছিলেন, “কলকাতা ফুটবলের শহর। সে জন্য তিন দিন এখানে কাপ রাখছি। সোমবার সারা দিন পুলিশ ক্লাবে সাধারণরা দেখতে পাবেন।”
যে কাপ এ বার নাকি আর বিশ্বকাপ নয়। বিশ্বের কাপ। বিশ্বকাপের এক গানেই তো বলে দেওয়া হচ্ছে, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ ইওরস।’ এই বিশ্ব কারও একার নয়, সবার। যে বিশ্বে অনায়াস সহাবস্থান ‘আমি’, ‘তুমি’, ‘আমরা’-র। যে বিশ্বের গর্বিত নাগরিক পেলে-কার্লোস আলবার্তো যেমন, ঠিক তেমন সম-মর্যাদায় স্বাগত সচিন-সৌরভ। যে বিশ্বে অক্লেশে মিশে যায় ফুটবল ও ক্রিকেট। কোনও বৈরিতা না রেখে!
|
ছবি: উৎপল সরকার। |
|
|
 |
|
|