অঘটন আজও ঘটে। যেমনটা ঘটল রবিবার রাতে, পাটুলি উপনগরীতে।
রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। গাভিন গরুটাকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখে ঠিক থাকতে পারেননি ওঁরা। তা সে কাজ সেরে বাড়ি ফেরা ক্লান্ত ফিরোজ, অঙ্কুর, কৃষ্ণ বা তাপসই হোক কিংবা পাশে আড্ডায় মশগুল অভীক, শোভনরা। সবাই দৌড়ে এসে ঘিরে ধরেছিলেন গরুটাকে। সে তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। বারবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। আবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। জিভ বেরিয়ে গিয়েছে। নাকের কাছটা ফেটে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে।
অভীক-ফিরোজরা তখনও জানতেন না, কতক্ষণ গরুটাকে আগলে থাকতে হবে। শীতের রাতে তবুও তাঁরা পিছপা হননি। সারা রাত গরুটাকে আগলে রেখে নয়া নজির সৃষ্টি করেছেন পাটুলির ওই বাসিন্দারা। বিশেষত কলকাতায় হামেশাই এখন অসুস্থ রোগীকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখেও বহু সময়েই মুখ ফিরিয়ে দেখেন না পথচলতি মানুষজন। সেখানে পাটুলির উদাহরণ একেবারেই ব্যতিক্রমী।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তিন-চারটি গরু ফিরছিল ঘরে। ফুটপাথ ধরে এগোনোর পথে আচমকাই রাস্তার কয়েকটি কুকুর তাদের তাড়া করে। ভয় পেয়ে একটি গরু নেমে পড়ে রাস্তায়। তখনই দুর্ঘটনা। উল্টো দিক থেকে দ্রুত বেগে আসা একটি মোটরবাইক সজোরে ধাক্কা মারে গরুটাকে। ছিটকে পড়ে যান মোটরবাইক আরোহী এবং গরুটাও। দৌড়ে আসেন আশপাশের ছেলে, স্থানীয়েরা। অন্য গাড়ি থেকে বাঁচাতে নিমেষে ঘিরে ধরা হয় জায়গাটা। প্রথমে গরুটাকে দাঁড় করিয়ে ফুটপাথে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। শেষে তা সম্ভব নয় বুঝে ফিরোজরাই নিয়ে আসেন পুলিশের ব্যারিকেড। রাস্তার এক দিক ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়।
ফিরোজের কথায়, “তখন পৌনে এগারোটা বাজে। বাড়ি ফিরছিলাম। একটা জটলা দেখে ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখি, গাভিন গরুটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। প্রাণপণে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার পড়ে যাচ্ছে। খুব কষ্ট হল। ঠিক করলাম, যে ভাবেই হোক ওকে বাঁচাতে হবে।” পরের দৃশ্যটা অভিনব। তিন-চার জন ছেলে ঘিরে বসে গরুটাকে। কেউ মাথায়, কেউ ঘাড়ে, কেউ বা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে চোখে-মুখে জলের ছিটে। নাগাড়ে গরুটাকে বলছেন, “ঘুমোবি না। ঘুমোলেই কিন্তু মরে যাবি। চোখ খুলে রাখ। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। চিন্তা করিস না।”
ওই রাতে ডাক্তার অবশ্য পাওয়া যায়নি। অভীকের কথায়, “বহু সংস্থা ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কারও কাছেই সাড়া মেলেনি। পুলিশ-দমকল এসেছিল। তারাও গরুটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উপায় বার করতে পারেনি। শেষে এক কম্পাউন্ডারকে এনে তাঁকে দিয়ে ডাক্তারের পরামর্শমতো ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। প্রথম ডেকাড্রন ইঞ্জেকশন। পরে দু’একটা স্নায়ুজনিত রোগের ইঞ্জেকশন। রাত দেড়টা নাগাদ গরুটার জিভ ধীরে ধীরে সচল হয়। খানিকটা নড়েচড়ে বসে।” তার পরেও অবশ্য গরুকে রাস্তায় ফেলে যাননি বাসিন্দারা। ঠান্ডায় তখন কেঁপে উঠছিল সে। কম্বল এনে চাপা দিয়ে তাকে শুইয়ে রাখা হয়। ভোরের দিকে দু’টি বাঁশে ভর দিয়ে গরুটাকে ফুটপাথে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল অবধি ঠায় বসে গরুটাকে পাহারা দিয়েছেন ফিরোজেরা। সকালে আশপাশের বাড়ি থেকে গরুর জন্য আসে গরম দুধ আর গুড়। ফিরোজ বলেন, “সারা রাত ও কিচ্ছু খায়নি। অনেক কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি। সকালে দুধ-গুড় খাওয়ায় আশ্বস্ত হই।”
শেষমেশ সোমবার সকাল দশটা নাগাদ মুকুন্দপুর পশু হাসপাতাল থেকে গাড়ি এসে গরুটিকে তুলে নিয়ে যায়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এখন ভালই আছে সেই গরু। ভাল আছে তার গর্ভের সন্তানও। হাসপাতালের এক কর্মীর কথায়, “এখনও পিছনের পায়ের দিকে আঘাত থাকলেও ভাল আছে গরুটা। সারা রাত ও-রকম শুশ্রূষা না পেলে তাকে বাঁচানো যেত না।”
এই ঘটনায় বিস্মিত পশুপ্রেমী দেবাশিস চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “পশুদের প্রতি সচেতনতা বেড়েছে দেখে ভাল লাগছে। যে ভাবে চিকিৎসা হয়েছে, সেটাও কিন্তু একেবারে সঠিক। জখম অবস্থায় গরুটিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে গেলে হিতে বিপরীত হত।” |