প্রবন্ধ ৩...
শব্দ, তুমি কোথায় যাইতেছ
বাংলা অভিধানে ‘সমকাম’ শব্দটা আছে? বাংলায় লেখা প্রথম বাংলা থেকে বাংলা অভিধান রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের। ১৮১৭-র সে অভিধানে শব্দটা থাকবে না, তা স্বাভাবিক। নেই সুবল মিত্রের সরল বাঙ্গালা অভিধান (১৯০৬) এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (১৯১৭)-এও। ১৯৪৬-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এর শেষ খণ্ড প্রকাশ পায়, সেখানেও নেই। রাজশেখর বসুর চলন্তিকা’য়ও না। এ শব্দ সংসদ বাংলা অভিধান-এ ঢুকেছে ২০০০ সালে।
অথচ, অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি জানাচ্ছে, ‘হোমোসেক্সুয়াল’ শব্দটা ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকের। তা হলে ‘সমকাম’-এর প্রবেশ এত বিলম্বিত কেন? বাংলা ভাষায় শব্দটির প্রথম ব্যবহার কবে? একই প্রশ্ন অন্য অনেক শব্দ নিয়েও। বস্তুত, যে কোনও শব্দ নিয়েই। আজ পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা অভিধানগুলি শব্দের অর্থ, প্রতিশব্দ, ব্যুৎপত্তি এবং ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দিলেও কী ভাবে প্রথম ব্যবহারের পরে ক্রমে শব্দের অর্থ বদলে যায়, সে বিষয়ে কোনও উল্লেখ করেনি। জরুরি সেই কাজটা সম্প্রতি শেষ হয়েছে ঢাকা বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে। গোলাম মুরশিদের সম্পাদকত্বে বারো জনের একটি দল প্রায় তিন বছরে তৈরি করেছে তিন খণ্ডের সেই নতুন ধরনের বাংলা অভিধান। এখনও পর্যন্ত এটাই সব থেকে বড় বাংলা অভিধান, ঢাকা থেকে জানালেন সম্পাদক।
প্রথম বাংলা অভিধান রচনার প্রায় দুশো বছর পরে বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান প্রকাশিত হতে চলেছে। অভিধানে শুধু শব্দের অর্থটাই তো থাকে না, ধরা থাকে একটা সমাজের মানসিকতা, একটা দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসও। ১৮৫৭’য় ‘দ্য ফিললজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন’ যখন একটি নতুন ইংরেজি অভিধানের প্রস্তাব করে, তখন সেই কথাটা মাথায় রাখা হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই ওইডি-র জন্ম। ওইডি-কেই আদর্শ করা হয়েছে বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে। কিন্তু ওইডি-র সঙ্গে তুলনা? এই অভিধানের সম্পাদক বললেন, তেমন তুলনা ‘‘শিশুতোষ, এমনকী হয়তো হাস্যকর। আমরা শর্টার অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি-র মডেলটাই নিয়েছি। তার বিশালতা এবং সূক্ষ্মতা নেওয়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল না।”
১৮৭৯-তে শুরু হয়েছিল ওইডি-র কাজ, শেষ হয়েছিল ১৯২৮-এ। জেমস মারে-র নেতৃত্বে ৪৯ বছর ধরে কাজটা করেছিলেন বিশাল এক সম্পাদনাকর্মী গোষ্ঠী। তার পরে, আজ পর্যন্ত ক্রমাগত তার সংস্করণ চলেছে, নিত্যনতুন শব্দ যুক্ত হয়ে চলেছে। অক্সফোর্ড-সূত্রেই জানা যাচ্ছে, শুধু পরিমার্জন এবং নতুন শব্দ অন্তর্ভুক্তি প্রকল্পেই আনুমানিক ৩ কোটি ৪০ লক্ষ পাউন্ড খরচ হয় ওইডি-র জন্য। পরিকাঠামো এবং অর্থ, দু’দিক থেকেই তুলনীয় কোনও বাংলা অভিধান প্রকল্প এখনও দূরকল্পনা।
তুলনীয় না হোক, বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করে এমন কোনও সরকারি সংস্থা অন্তত ওই ধরনের কোনও অভিধানে উদ্যোগী হবে, এমন আশা করার সঙ্গত কারণ ছিল। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কাজটা করতে পারত। এর প্রথম সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায় ভাষার উপরেই বেশি জোর দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু দু’একটি ছোটখাটো উদ্যোগের পরে আকাদেমি বেশি মন দিয়েছে রচনাবলিতে, এমনকী বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাবলিতেও! তবে আপাতত ঢাকা বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে যে অভিধানটি প্রকাশিত হতে চলেছে সেটা রীতিমত আশা জাগায়। কয়েকটি পৃষ্ঠা ই-মেল মারফত পাঠিয়েছেন গোলাম মুরশিদ। তা থেকেই কাজটা সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়।
যেমন ধরা যাক ‘অনুবাদ’ শব্দটাই। এই শব্দটি বললে আজ আমরা বুঝি তর্জমা। কিন্তু উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত এই অর্থে শব্দটি ব্যবহারই হত না। তার আগে অনুবাদ-এর অর্থ ছিল বাধা, প্রতিকূলতা। সেই অর্থটা আজও বহন করে ‘বাদানুবাদ’ শব্দটি। কিন্তু ভাষান্তর বা তর্জমা অর্থে শব্দটার ব্যবহার সম্ভবত অক্ষয়কুমার দত্ত করেন, ১৮৪২-এ। কম্পিটিশন-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘প্রতিযোগিতা’র ব্যবহারও উনিশ শতকের শুরুতে। ১৮০২-এ উইলিয়ম কেরির রচনায় পাচ্ছি, ‘তাহার প্রতিযোগিতার লোক আমার দেশে নাই।’ সম্ভবত এটিই শব্দটির এখনও পর্যন্ত পাওয়া আদি ব্যবহার, জানাচ্ছে এই নতুন অভিধান।
সব শব্দের প্রথম ব্যবহারের তথ্য নির্ভুল, এমনটা অবশ্যই নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে কিছু সংশয়ও তৈরি হয়। যেমন, এই ‘প্রতিযোগিতা’ শব্দটা নিয়েই। অভিধান জানাচ্ছে, ১৮৭৫-এ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ‘বিপক্ষের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা ঘটে, স্বপক্ষের সঙ্গে নহে।’ কিন্তু অভিধানে একটা তর্ক ওঠেনি, হয়তো ওঠা সম্ভবও নয়— বঙ্কিমই যদি আমাদের চেনা অর্থে প্রতিযোগিতাকে প্রথম ব্যবহার করে থাকেন, তা হলে ‘বঙ্গদর্শন’-এ ১৮৮১-তে ‘নূতন কথা গড়া’ প্রবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কেন লিখবেন, ‘উকিলিতে আজকাল বড়োই competition. এখন competition শব্দে যে ভাব ব্যক্ত হয়, বাংলা ভাষায় তাহা ব্যক্ত করিবার কোনও কথা নাই। আমরা কী করিব? ঐ শব্দটি কি বাংলা করিয়া লইব, না উহার পরিবর্তে সংস্কৃত ধাতুপাঠ খুঁজিয়া ‘সংঘর্ষ’ শব্দ গড়িয়া লইব। না বলিব, উকিলিতে আজকাল অনেক লোক হইয়াছে, অতএব উহাতে পসার করা বড়োই শক্ত।’ বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা পড়েননি হরপ্রসাদ? পড়লেও খেয়াল করেননি? না কি, কম্পিটিশন অর্থে প্রতিযোগিতাকে মানতে পারেননি?
নতুন কথা গড়া বা অন্য ভাষা থেকে শব্দ নেওয়ার প্রয়োজন দ্রুত বদলে যেতে থাকা এই বিশ্বে বেড়েই চলেছে। নতুন নতুন ধারণার জন্ম হচ্ছে, জমে উঠছে নতুন নতুন তর্ক। সেই প্রয়োজনেই এই অভিধান, বলছেন গোলাম মুরশিদ, ‘‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং হরিচরণ যে-ভাষার অভিধান রচনা করেছিলেন, সেই বাংলা ভাষা আর এখনকার বাংলা ভাষা ঠিক এক নয়— বাংলাদেশেও নয়, পশ্চিমবঙ্গেও নয়। হরিচরণ তাঁর শব্দকোষে সংস্কৃত ভাষার প্রতি যে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার চর্চায় তার প্রাসঙ্গিকতাও এখন অনেকটা হারিয়ে গেছে— উভয় বাংলাতেই। বস্তুত, নতুন অভিধান তৈরি করা এজন্য একান্ত দরকার হয়ে পড়েছিলো। কেবল নতুন নয়, নতুন ধরনের অভিধান রচনারই প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো।’’
নতুন শব্দ, বিশেষ করে যৌগিক শব্দকেও এই অভিধান স্বীকৃতি দিয়েছে। তা ব্যাকরণে অশুদ্ধ হলেও। বলছেন সম্পাদক, “এই অভিধান তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ নতুন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন পঁচিশ হাজারের বেশি। আরও দু’জন কবি, নতুন দুটো শব্দভাণ্ডারের দরজা খুলে দিয়েছিলেন, নিজেদের কবিতায় তাদের ব্যাপক ব্যবহার করে। নজরুল ইসলাম আরবি-ফারসির, জসিমউদ্দিন অযত্নের ধুলোয় চাপা পড়া পল্লির অন্তহীন উপকরণের। সে সব শব্দেরও বিবর্তনমূলক অন্তর্ভুক্তি এই অভিধানে রাখা হয়েছে।”
পূর্বপ্রকাশিত অভিধান থেকে ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ এবং কিছু নতুন সংযোজন নয়, মনের জানালা খোলা রেখে যথার্থ অনুসন্ধানে প্রায় তিন বছর ধরে এই অভিধানের কাজ চলেছে। ব্যবহৃত হয়েছে কলকাতার মেয়র’স কোর্ট-এর কাগজপত্র, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত তাঁতিদের চিঠিপত্রের মতো সম্পূর্ণ নতুন উপাদানও। নতুন করে দেখা হয়েছে কলকাতাকেন্দ্রিক প্রামাণ্য ভাষার উপরে বাস্তুহারাদের প্রভাবও। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দুই বাংলাতেই বাংলা ভাষায় যে প্রভাব ফেলেছে তারও একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে এ অভিধান থেকে, দাবি সম্পাদকের। বললেন, “বাংলা ভাষায় এখনও যে সব অভিধান সংকলিত হয়েছে, তাদের মধ্যে আমরা সজ্ঞানে সবার আগে আমাদের অভিধানটি যাতে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ, হিন্দু-মুসলমান সবাই ব্যবহার করতে পারেন সে দিকে সংকল্পিত প্রয়াস রেখেছিলাম।”
সবচেয়ে বড় বাংলা অভিধান জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ পনেরো হাজার। গোলাম মুরশিদ জানাচ্ছেন, প্রায় শতবর্ষ পরে এই নতুন ধরনের বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে তিন খণ্ড মিলিয়ে শব্দসংখ্যা হবে সওয়া লাখের কিছু বেশি। সেখানেই কি দাঁড়ি টানবেন? আজি হতে শতবর্ষ পরে সময়-সুযোগ ঘটলে আর পাঁচটা অভিধানের মতো সংস্করণ হবে এর? “একেবারেই নয়। প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন থেকেই আমাদের এই অভিধান পুরনো হতে আরম্ভ করবে। একটি স্থায়ী অভিধান বিভাগ গঠন করে অভিধানটিকে নিরন্তর পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। দরকার এর অনলাইন সংস্করণেরও। এর জন্য পরিকাঠামো তৈরি করা উচিত।”
দুই বাংলার আদানপ্রদানের বেশ কিছু সরকারি উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সরাসরি ট্রেন চলছে ভারত থেকে বাংলাদেশে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া সরাসরি বাংলাদেশের লেখকের গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করছে। ভাষার জন্য সেই পরিকাঠামো যৌথ ভাবে তৈরি করতে পারে না দুই বাংলা অ্যাকাডেমি?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.