নারী ও পুরুষের সম্মিলিত শক্তিতে সমৃদ্ধ সমাজ। সমাজের এগিয়ে চলার নেপথ্যে নারীশক্তির ভূমিকা অদ্বিতীয়। তাঁরা সর্বত্রই দক্ষতার সঙ্গে চালিকা ও পালিকা শক্তি হয়ে ওঠেন। এ কথা সমাজ ও পরিবারতন্ত্রে যথেষ্ট পরিলক্ষিত। এই নারী বা মাতৃশক্তিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। বরং তাঁদের হাত ধরেই উত্তরণ ঘটে ব্যষ্টি ও সমষ্টিজীবনে। এ চিত্র রামকৃষ্ণ-সাম্রাজ্যেও পরিস্ফুট। এ কালের অন্যতম সমাজতন্ত্রী ও যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ শ্রদ্ধার সঙ্গে এই শক্তিকে সম্মান জানিয়েছেন এ ভাবে: “এমন কেউ ছিল না, যে একটু সহানুভূতি জানাবে আমাদের, শুধু একজন ছাড়া। তিনি একজন নারী। একমাত্র তিনিই আমাদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করতেন। যদিও তিনি ছিলেন অসহায়, আমাদের চেয়েও দরিদ্র।” সেই মহোত্তমা নারীটি হলেন শ্রীশ্রীমা সারদা। যিনি রামকৃষ্ণ-পরিবারের মধ্যমণি ও জননী।
তিনিই অনুভব করেছিলেন তপোদ্দীপ্ত প্রব্রজ্যাধারী সন্তানদের সংগ্রামের কথা। অর্ধাশনে অনশনে দিনযাপনের কথা। নবীন সন্ন্যাসীদের এই নিদারুণ কষ্টে ব্যথাতুর হয়ে উঠল শ্রীশ্রীমায়ের হৃদয়। নিভৃতে আকুল আবেদন জানালেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে, ‘তোমার ছেলেরা ঘোরে পথে পথে, কোনও আশ্রয় নাই— মুখ তুলে চাও দয়াল ঠাকুর।’ মায়ের অন্তরের আবেগ, আর্তনাদ আর আকুতির ফলস্বরূপ এই রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘরূপ পরিবার। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আরও প্রার্থনা জানিয়েছিলেন এ ভাবে : ‘এই করো যাতে তোমার ছেলেরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। এদের যেন মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব না থাকে।’ এর পর ক্রমে বরাহনগরে, আলমবাজারে, বেলুড়ে মঠ হল। মাথাগোঁজার ঠাঁই হল পরিব্রাজক-সন্তানদের। মায়ের ব্যাকুল প্রার্থনা বাস্তবায়িত হল। |
শ্রীরামকৃষ্ণ আদর্শ, শ্রীশ্রীমা তার রূপরেখা। স্বামী ভূতেশানন্দজির কথায় বলা যেতে পারে: ‘রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘ মায়ের প্রার্থনার ফল। ...ঠাকুর আদর্শ দিয়েছেন, কিন্তু তাতে রসসৃষ্টি করেছেন মা। সেই রসবারি সিঞ্চন না করলে সঙ্ঘের চারাগাছটিই নষ্ট হয়ে যেত। আজ জগদ্ব্যাপী শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবপ্রবাহের ধারা বয়ে চলেছে। এর মূলে রয়েছেন মা।’ তিনিই এই সঙ্ঘের ধারয়িত্রী, পালয়িত্রী। তাই স্বামীজি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সময়ে (১ মে ১৮৯৭) বলেছিলেন সকলের উদ্দেশে: “শ্রীশ্রীমাকে কি রামকৃষ্ণদেবের সহধর্মিণী বলে, আমাদের গুরুপত্নী হিসেবে মনে করো? তিনি শুধু তাই নয় রে ভাই, আমাদের এই যে সঙ্ঘ হতে চলেছে, তিনি তার রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, তিনি আমাদের সঙ্ঘজননী।” বাস্তবিক, জননীর মতো সকলের প্রতি ছিল তাঁর সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্য-সম্পর্ক। খুঁটিনাটি ব্যাপারেও থাকতেন ওয়াকিবহাল।
জননী যেমন স্নেহ-মমতা-করুণা দিয়ে সকলকে লালন-পালন করেন, ঠিক তেমনই ভাবে বৃহত্তর রামকৃষ্ণ-পরিবারকেও শ্রীশ্রীমা সন্তানস্নেহে সেবা ও বাৎসল্যে আগলে রাখতেন কৃপা করে। এক সময়ে আশ্রমের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তার মধ্যেই মা সকলের সেবাযত্নের কোনও ত্রুটি হতে দিতেন না। ভক্ত-সন্তানদের প্রতি তাঁর ছিল অনাবিল ভালবাসা, অহৈতুকী করুণা। কারও ব্যবহারে কোনও সন্তান অসন্তোষ প্রকাশ করলে মা ব্যথা পেতেন। অপরের দুঃখ-কষ্টে হয়ে উঠতেন সমব্যথী। ব্যথিত সন্তানের প্রতি স্নেহের অর্গল তুলে মা বলতেন, ‘সে কি গো? ... ভালবাসাই তো আমাদের আসল। ভালবাসাতেই তো তাঁর (ঠাকুরের) সংসার গড়ে উঠেছে।’
এ ভাবে তিনি ভালবাসার সূত্রে বেঁধে রাখতেন সঙ্ঘসেবকদের। কোমলে-কঠোরে সঙ্ঘরূপ শাবককে ধারণ, পালন ও সৃজন করতেন। রাখতেন সর্বত্র সজাগ দৃষ্টি। করুণার পূত-পেলব-স্পর্শ। এক ব্রহ্মচারীকে কোনও অপরাধে মঠ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি শ্রীশ্রীমায়ের কাছে চলে যান। মা তাঁকে ক’দিন কাজে রাখেন ও একটা চিঠি দিয়ে তাঁকে ফেরত পাঠান মঠে। মা লিখেছিলেন, ‘বাবাজীবন তারক, এই ছেলেটি অপরাধ করেছে। এখন সে অনুতপ্ত। একে মঠে স্থান দিও।’ মহাপুরুষ মহারাজ এই চিঠি পড়ে বলেন, ‘ব্যাটা, তুই একেবারে হাইকোর্টে আপিল করেছিস।’... শ্রীশ্রীমায়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাঁর কথার ওপর কোনও কথাই আর চলে না। তিনিই সন্তানদের পরম আশ্রয় ও চরম নির্দেশিকা। দেবীসূক্তে দেবীর ঘোষণা: ‘অহং রাষ্ট্রী’— আমিই জগতের সম্রাজ্ঞী। দেবী সারদা এমন ভাবে ঘোষণা না করলেও আচরণে সে বার্তাই প্রতিধ্বনিত। প্রতিফলিত, তিনিই রামকৃষ্ণ-সাম্রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী।
শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরে থাকা কালে সারদাদেবীকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ গা, তুমি কি কিছু করবে না? এ-ই (নিজেকে দেখিয়ে) সব করবে?’ তদুত্তরে মা জানিয়েছিলেন, ‘আমি মেয়েমানুষ, আমি কী করতে পারি?’ মা নিজেকে অবগুণ্ঠনে আবৃত রাখতে চেয়েছিলেন সামান্য মেয়েমানুষ বলে। কিন্তু তিনি তো অসামান্য। তাই তো শ্রীরামকৃষ্ণকে বলতে হয়েছে, ‘ও আমার শক্তি।’ এই শক্তিময়ী সারদাদেবীর বাস্তবায়ন ঘটে কর্মকুশলতায়। তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাশীলতায় সংগঠনী শক্তি বৃদ্ধি হয়। মাতৃত্বের স্নেহছায়ায় সকলকে আশ্রয় দেন, দেবীত্বের পরম-পরশে মানুষের দিব্যশক্তির উন্মেষ হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব ও আদর্শের রূপায়ণ সঙ্ঘনেত্রীর ভূমিকায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ একবার সারদাদেবীকে বলেছিলেন— ‘এর চেয়ে (নিজেকে দেখিয়ে) ঢের বেশি করতে হবে (তোমাকে)।’ কিন্তু মা সারদা কি ঢের বেশি করতে পেরেছিলেন? এমন ধরনের প্রশ্নে মা আশ্বস্ত করেছিলেন এক সন্তানকে এ ভাবে : ‘বাবা, আদর্শ হিসাবে যতটা করা প্রয়োজন, তার থেকে ঢের বেশি করে গেলাম।’ আজ জগৎজুড়ে অজস্র অযুত সন্তান যখন মা বলে ডাকেন তখনই তো তাঁর বিশ্বজনীন মাতৃত্বের পূর্ণতা, বিশ্বজুড়ে রামকৃষ্ণ-পরিমণ্ডলে যখন মাতৃরূপে পূজিতা হন তখনই তাঁর সঙ্ঘজননী রূপের পূর্ণায়ন। আর যখন তিনি প্রতিশ্রুতি দেন— ‘জানবে, তোমার একজন মা আছেন।’ —তখন আমরা সবাই আশ্বস্ত হই নবপ্রাণে, উদ্দীপ্ত হই নবচেতনায়। |