দাঙ্গাকবলিত মুজফ্ফরনগরের ত্রাণ শিবিরগুলিতে এখন বিয়ের হিড়িক। গত তিন মাসে শিবিরাশ্রিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে অন্তত সাতশো বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধিকাংশ পাত্রী নাবালিকা। একে ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব রায়ট্স’ আখ্যা দিলে বড় নির্মম ও নিষ্ঠুর শোনাবে। ত্রাণ শিবিরের এই অকালমধুমাসের পিছনে প্রণয়ের আশ্লেষপূর্ণ আখ্যান নেই, আছে সরকারের কাছ থেকে নববিবাহিত দম্পতির লক্ষ টাকা বাড়তি ‘ক্ষতিপূরণ’ প্রাপ্তির আকর্ষণ আর ত্রাণ-শিবিরের নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে-থাকা অনূঢ়া কন্যাসন্তানদের যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শঙ্কা থেকে মুক্তির তাড়না। সেই যৌথ তাগিদ থেকেই কান্ধলা, শাহপুর, শাম্লি প্রভৃতি জনপদের শিবিরে একের পর এক গণবিবাহ হয়ে চলেছেন। এক পরিবারের ৯টি বালিকা ‘বধূ’ হয়েছে। দাঙ্গায় এই পরিবারগুলি সর্বস্ব খুইয়েছে। সরকারি অনুদানের অর্থে এখন যদি তড়িঘড়ি বিয়েটা সেরে ফেলা যায়। কে জানে কবে আবার সরকারের মতি বদলে যায়! ইতিমধ্যেই তো ক্ষতিপূরণ বা ত্রাণসাহায্য লাখ থেকে ১৫ হাজারে, ৫ হাজারেও নেমেছে। সেটাও অনেকেই পাচ্ছে না।
এ দিকে দাঙ্গায় যত মানুষ মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি লোক ইতিমধ্যেই ত্রাণ-শিবিরে মৃত। সরকারি ঔদাসীন্য, ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকরতা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কড়া ঠান্ডা আর চিকিৎসার অভাব, অপুষ্টি ও দারিদ্রে মারা যাচ্ছে প্রধানত শিশুরা। শিবির লাগোয়া গোরস্তানেই পুঁতে দেওয়া হচ্ছে তাদের দেহ। তীব্র ঠান্ডায় অন্তত ৪০টি শিশু মারা যাবার পর সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে ত্রাণ শিবিরে চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরির নির্দেশ দিলে লোই গ্রামের শিবিরে দু’জন ডাক্তার পাঠিয়ে দায়সারা স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়া হয়েছে। ওই শিবিরেই কয়েকশো প্রসূতি সন্তানজন্মের অপেক্ষায়, তাদের ক’জন বাঁচবে, কে জানে! |
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েরা, যে কোনও যুদ্ধে, রাষ্ট্রবিপ্লবে কিংবা দাঙ্গায় বরাবর যাদের উপর দিয়েই বয়ে যায় যাবতীয় ঝড়। যারা স্কুলকলেজে পড়ত, তারা শিবিরের বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। বাবা-মায়েরাও চাইছেন না এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাস্তাঘাটে বেরিয়ে মেয়ের কোনও ক্ষতি হোক। ইতিমধ্যেই ত্রাণ-শিবিরে ঢুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফলে পড়াশোনা এক রকম বন্ধ।
শরণার্থীরা গ্রামে ফিরবেন, তারও উপায় নেই। বাসিকালান শিবিরের মুসলিম শরণার্থীদের সরকার গ্রামে ফেরাতে গেলে লাগোয়া গ্রামের হিন্দু বাসিন্দারা তীব্র আপত্তি জানান। তাঁরা বাস্তুজমি কিনে নতুন করে ঘর বাঁধতে চাইলেও আপত্তি। শিবিরের অস্থায়ী জীবনই কি তবে এই হাজার হাজার সংখ্যালঘুর নিয়তি? শিবিরগুলিতে এখনও ৫৫ হাজার দাঙ্গাদুর্গত রয়ে গেছেন। তাঁদের ফেলে আসা জমি-জিরেত বাগান-পুকুর ভদ্রাসন বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ভাগ্যবান, প্রতিবেশী জাঠ পরিবারের কাছে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে বেচে দিচ্ছেন। প্রথম বিক্রির তারিখ: ৬ ডিসেম্বর! সরকারের ঘাড়ে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের বোঝা। সেই অভিবাসীরা অগত্যা ত্রাণ শিবিরের কাছে পাকা সড়কের ধারে আখের খেতের জমি ১২২ গজের প্লট করে কিনে নিয়ে নতুন ঘর বাঁধছেন। গ্রামে ফিরলেই যে আক্রমণ! এফআইআর-এ যে ওই গ্রামবাসীদেরই নাম রয়েছে!
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই জাঠ ভূমি খাপ পঞ্চায়েতের খাস তালুক। হিন্দুত্ববাদীরা সেখানে সমাবেশ ঘটায়। হিন্দু নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রোধ জাগিয়ে তোলে। পরিকল্পিত ভাবে প্রচারিত হয় ‘প্রেম-জেহাদ’-এর রূপকথা, কেরল, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে ইতিপূর্বে যার সফল পরীক্ষা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছড়ানোয় নারীর সম্ভ্রমহানির আখ্যায়িকা বরাবরই সুবিধাজনক হাতিয়ার। দেশভাগের আগে ও পরে এই সংক্রান্ত গুজবের ভিত্তিতেই বহু দাঙ্গা হয়েছে। ভারতে বেছে বেছে আহরণ করা কিছু গল্পকথা মুসলিম পুরুষদের দ্বারা হিন্দু নারীর সম্ভ্রমনাশের আখ্যানবৃত্তকে পুষ্ট করেছে। হিন্দু সমাজের মগ্নচৈতন্যেই এই বোধ সঞ্চারিত করে দেওয়া হয়েছে যে, হিন্দু নারীরা মুসলিম পুরুষদের সান্নিধ্যে নিরাপদ নয়।
মুজফফরনগরে দাঙ্গার ঠিক আগে খাপ মহাপঞ্চায়েতের সমাবেশমঞ্চ থেকে তোলা ‘বেটি বচাও, বহু বচাও’ স্লোগান তাই ক্রমশ ‘বেটি বচাও, বহু বনাও’ অর্থাৎ ‘নিজের কন্যার সম্ভ্রম রক্ষা করো, আর অন্যের (এখানে মুসলমানের) কন্যাদের পুত্রবধূ বানাও (বা ধর্ষণ করো)’ স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছিল। নারীর যৌন পছন্দ বা স্বাধিকার খর্ব করার খাপ পঞ্চায়েতি এজেন্ডা আর্যাবর্তের হৃদয়পুরে নানা ভাবে কার্যকর হতে দেখেছি। এখানে সেটা মুসলিম ‘অপর’-এর দানবায়নের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার সঙ্গে একাকার।
মনে রাখা দরকার, খাপ পঞ্চায়েত কেবল উত্তরপ্রদেশ নয়, কংগ্রেস-শাসিত হরিয়ানাতেও ব্যাপক গণভিত্তি ধরে। কার্ফু জারি থাকা সত্ত্বেও দাঙ্গা-পূর্ববর্তী মহাপঞ্চায়েতে যাঁরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কে দিতে হাজির ছিলেন, হুকুম সিংহ, সুরেশ রানা বা সঙ্গীত সিংহ সোম-এর মতো বিজেপি বিধায়করা ছাড়াও তাতে সোৎসাহে যোগ দিয়েছিলেন নরেশ টিকায়ত ও রাকেশ টিকায়তের মতো জাঠ ধনী কৃষক নেতাও। ওই স্পর্শকাতর সময়ে তাঁদের কেন তা করতে দেওয়া হয়েছিল, কেন পুলিশ ও রাজ্য-প্রশাসন নীরব ও নিশ্চেষ্ট দর্শক ছিল, সমগ্র আর্যাবর্তে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর জন্য নিন্দিত মুলায়ম সিংহ যাদব বা তাঁর পুত্র এখনও তার কোনও জবাব বা ব্যাখ্যা দেননি। |