মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে শাসনপ্রণালীর ক্ষেত্রে তাঁহার পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেকটাই গতিশীল, তৎপর, উদ্দেশ্যমুখী, তাহা রাজ্যবাসী দেখিতে পাইতেছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক ও দফতরের কাজকর্মের অগ্রগতি নিয়মিত খতাইয়া দেখা ইহারই লক্ষণ। সুলক্ষণ। সরকারের ৫৮টি দফতরের সব কয়টির মন্ত্রী ও সচিব-আমলাদের একত্রে বসাইয়া প্রায় ক্লাস লওয়ার ভঙ্গিতে তাঁহার তদারকি, হিসাব লওয়া, জবাবদিহি চাওয়া, ভাল কাজ করার জন্য প্রশংসা এবং ঠিকঠাক কাজ না-করার জন্য তিরস্কার করার পদ্ধতি যথাযথ। যেহেতু মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ও ভঙ্গিতে এক ধরনের আন্তরিক স্বচ্ছতা থাকে, সুতরাং সর্বসমক্ষে তিরস্কৃত হইবার গ্লানিবোধও হয়তো ক্রমশ কমিয়া আসিতেছে।
প্রসঙ্গত, বামফ্রন্ট সরকারের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকেও সরকারি দফতরের কোট-ঝোলানো শূন্য চেয়ার দেখিয়া বলিতে শুনা গিয়াছিল, ‘কাহাকে কাজ করিতে বলিব, চেয়ারকে?’ তাঁহার উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাকরণে কর্মসংস্কৃতি ফিরাইবার জন্য স্লোগান দিয়াছিলেন: ‘ডু ইট নাও’ বা ‘এখনই করুন’। বামপন্থী কর্মী-সংগঠন পত্রপাঠ স্লোগানটির নিহিত বার্তায় অন্তর্ঘাত ঘটাইবার অভিসন্ধি চরিতার্থ করিয়াছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু প্রথমাবধি কর্মী-অফিসারদের অভিপ্রায়ের উপর নির্ভরশীল না থাকিয়া তাঁহাদের বুঝাইয়া দেন, কাজ করার জন্যই সরকারি কোষাগার হইতে তাঁহাদের বেতন দেওয়া হয়। উপরন্তু মন্ত্রী হইতে সচিব তথা পদস্থ আমলাদের স্তর পর্যন্ত সকলকে সরকারি কর্মসূচি রূপায়ণে দায়বদ্ধ করিয়া কয়েক মাস পর পর কাজের খতিয়ান লওয়া এবং ধার্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অগ্রগতি ও সমস্যা লইয়া বৈঠক শুরু করেন। আর ইহাতেই ফল লক্ষিত হয়। পঞ্চায়েত, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, কৃষি, খাদ্য, পূর্ত প্রভৃতি মন্ত্রক ধার্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দৃষ্টান্তমূলক কৃতকার্যতা দেখাইতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী এই সকল মন্ত্রক এবং তাহাদের মন্ত্রী-সচিব-অফিসারদের অকৃপণ প্রশংসাও করিয়াছেন। আশা করা যায়, এই প্রশংসা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলিকে আরও উৎসাহিত করিবে। শাসনপ্রণালী হিসাবে এই তদারকি, খতিয়ান এবং পরীক্ষাগ্রহণ স্বাগত।
প্রশ্ন যে একেবারে নাই, তাহা নহে। যেমন মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার সরকারের দফতরগুলিকে নম্বর দিতে গিয়া প্রধানত বাজেটে বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করার উপর গুরুত্ব দিয়াছেন। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই। বিশেষত বাম জমানায় উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দফতরকে মঞ্জুর করা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বরাদ্দ খরচ করিতে না পারায় যে উন্নয়ন ব্যাহত হয়, বরাদ্দ অর্থ ফেরত যাওয়ায় নূতন বরাদ্দও অনুমোদিত হয় না, ইহা স্মরণে রাখিলে খরচের উপর জোর দেওয়ার তাৎপর্য বুঝা যায়। তথাপি পর্যাপ্ত টাকা খরচ করিতে পারাই কোনও সরকারি মন্ত্রক বা দফতরের কার্যকারিতার একমাত্র কষ্টিপাথর হইতে পারে না। সেই অর্থ কীসে, কোথায়, কতটা খরচ হইল, অপব্যয় হইল কি না, যাঁহাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ হইয়াছে, তাঁহারাই সুফল পাইলেন কি না, এই প্রশ্নগুলিও জরুরি। আশা করা যায়, মুখ্যমন্ত্রীর পরীক্ষা পদ্ধতি ক্রমে সংস্কৃত ও উন্নত হইবে। কিন্তু তিনি মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়া চালু করিয়াছেন, ইহা অনস্বীকার্য। এই প্রক্রিয়া যত চলিবে, ‘ছাত্রছাত্রীরা’ পড়াশুনায় ততই মন দিতে বাধ্য হইবেন। পাশ করিতে না পারিলে তিনি যে উচ্চতর শ্রেণিতে তুলিবেন না (প্রয়োজনে মন্ত্রিসভার টিমটাই বদলাইয়া ফেলিবেন), এই সতর্কবাণীটি বিশেষ মূল্যবান। |