অবশেষে দিল্লিতে সরকার গঠনে সম্মত হইয়াছে আম আদমি পার্টি। দলনেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনী ফলপ্রকাশের পর অন্তত ২৮০টি জনসভায় জনমত যাচাই করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। আপাত-অরাজনৈতিক সংগঠন আম আদমি পার্টির সাফল্যের ন্যায় এই ঘটনাও দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে নজিরবিহীন, যেখানে জনাদেশে সরকার গড়ার অনুমোদন পাইবার পরও কোনও দলনেতা জনসাধারণের দরজায় দরজায় ঘুরিয়া আরও এক দফা জনমত যাচাই করিতেছেন। ইহার প্রয়োজন হয় অবশ্য আম আদমি পার্টি-সহ কোনও দলই সুস্পষ্ট পরিষদীয় গরিষ্ঠতা হাসিল করিতে না পারায়। তবে অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতিতে দল ভাঙাইয়া বিধায়ক সংগ্রহ করার এবং সরকার গঠনের যে অগণিত নজির ভারতীয় রাজনীতিতে রহিয়াছে, দিল্লির ক্ষেত্রে তাহার কোনও চেষ্টাও যে দেখা যায় নাই, তাহার তাৎপর্য কম নয়। ইহার পিছনে আম আদমি পার্টির দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের একটি আদর্শগত প্রভাব অনস্বীকার্য।
বস্তুত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া আম আদমি পার্টি রাজনীতির প্রচলিত পরিভাষা ও ধাঁচটাই অনেকাংশে পাল্টাইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে। দুর্নীতির কলুষকে সম্মার্জনী দিয়া বিদায় করার স্লোগান দেওয়া এই দল নির্বাচনী প্রতীক হিসাবেও সম্মার্জনীকেই ব্যবহার করিয়াছিল। মূলত ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সরকারকেই সেই সম্মার্জনী দিয়া বিদায় করা হইয়াছে। কিন্তু বিরোধী দল বিজেপি যে সেই শূন্যতার পূর্ণ সুযোগ লইতে পারে নাই, তাহার কারণ ভোটদাতারা বিজেপিকেও পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত দল বলিয়া গণ্য করেন নাই। এখানেই আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের শূন্য স্থান পূরণে বহুলাংশে সক্ষম। সরল পাটিগণিত অনুযায়ী অবশ্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল একক শক্তিতে সরকার গড়ায় সক্ষম ছিলেন না, তাঁহাকে দুই দলের কোনও একটির সাহায্য লইতেই হইত, যাহাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁহার আন্দোলন। মাত্র আট জন বিধায়ক লইয়া কংগ্রেস যে এই পরিস্থিতিতে আম আদমি পার্টির সরকারকে সমর্থন দিতে আগাইয়া আসিল, তাহার পর কেজরিওয়াল কিছুটা দ্বিধায় পড়িয়া যান। কিন্তু নির্বাচনে লড়া তো জেতার জন্যই, আর জেতাও সরকার গড়ার জন্যই। বিকল্প সরকার দিবার দায়িত্ব এড়াইয়া গেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইও অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে। অগত্যা কতকটা নিমরাজি হইয়াই কেজরিওয়ালকে লেফটেনান্ট গভর্নরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সবুজ-সংকেত দিতে হইয়াছে। তাহার আগে দ্বিধামুক্ত হইতেই তিনি একের পর এক জনসভা করিয়া জনতার আদালত হইতে নূতন করিয়া রায় চাহিয়াছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে ইহাও এক নূতন পদ্ধতি।
এই সরকার কত দিন টিকিবে, কংগ্রেস অতীতের মতো নিজের পক্ষে সুবিধাজনক সময়ে সরকারের প্রতি সমথর্ন তুলিয়া লইবে কি না, আম আদমি পার্টি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে কতটা সফল হইবে, এই সব সংশয় ও প্রশ্নের উত্তরই ভবিষ্যতের গর্ভে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানাইয়া দিয়াছেন, প্রতিশ্রুতি মতো তাঁহার সরকার কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধেই ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করিবে, তাহাতে যদি বিপাকে পড়া কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে, ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকিতে আম আদমি পার্টি তবু দুর্নীতির সহিত আপস করিবে না। শেষ পর্যন্ত কেজরিওয়ালের এই রাজনৈতিক নিরীক্ষা কত দূর সফল হইবে, এখনই বলা কঠিন। তবে তাঁহার পরীক্ষানিরীক্ষার তাৎপর্য ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন নূতন শক্তি, মানসিকতা ও পদ্ধতিকে আপন অঙ্গে ধারণ করিয়াই ভারতীয় গণতন্ত্র ক্রমশ সমৃদ্ধ হইয়াছে। আম আদমি পার্টির ক্ষেত্রেও ঐতিহ্য সমানে চলিতেছে। এখানেই গণতন্ত্রের শক্তি। |