বদলটা শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগেই। এ বার সেই পথেই আরও এক কদম এগোল পার্ক স্ট্রিট।
কলকাতার সাবেক ফুড স্ট্রিটে নিছকই সাহেব-মেমদের একচেটিয়া রমরমা এখন বিস্মৃত ইতিহাস। এমনকী ষাটের দশকে খানাপিনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জমাটি গান-বাজনার দিনগুলোও ঢের দূরের। তার বদলে ব্যস্ত নাগরিকের কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণ অবসর যাপনের কফিশপ বা চটজলদি ক্ষুন্নিবৃত্তির আউটলেটই ‘ইন থিং’। এই বড়দিনের মুখে তা আর এক বার বুঝে নিল কলকাতা।
সৌজন্যে শহরের আনকোরাতম কফিশপ, কাফে অ বঁ প্যাঁ (এবিপি কাফে)। আদতে বস্টনের একটি নামজাদা কফিঠেকেরই কলকাতা-সংস্করণ এটি। গত দু’দশক ধরে কলকাতাবাসীর প্রিয় ঠিকানা মিউজিক ওয়র্ল্ড-এর শূন্যস্থান ভরাট করতে সোমবার বিকেল থেকেই হাজির হয়েছে তারা। বছর পাঁচেক আগে ঠিক এ ভাবেই উল্টো দিকের ফুটপাথে কলকাতার অন্যতম প্রিয় রেস্তোরাঁ ব্লু ফক্স-এর ঠিকানায় ঘাঁটি গাড়ে আমেরিকান বার্গারবীর ম্যাকডোনাল্ড্স। ওই তল্লাটে ইতিমধ্যেই চিকেনখোরদের প্রিয় কেএফসি-ও রমরম করছে। একদা এ শহরের রসনারুচির উৎকর্ষের অহঙ্কার স্কাইরুম যেখানে রাজত্ব করত, তার আশপাশেও দু’টি নতুন রেস্তোরা।ঁ বহুজাতিক পিৎজা চেন পিৎজাহাট কাফে খুলেছে, লাউঞ্জ রেস্তোরাঁ ভেদা-ও হেসেখেলে ব্যাটিং করছে।
সাবেক কলকাতার স্মৃতিমাখা মোক্যাম্বো, মুল্যাঁ রুজ, অলি পাবেরা কেউ কেউ এখনও মাথা উঁচু করে টিকে থাকলেও ধাপে-ধাপে বদলটাই পার্ক স্ট্রিটের চরিত্র হয়ে উঠেছে। এমনকী সাবেক ফ্লুরিজ-ও ক’বছর আগে জরার চিহ্ন ঢাকতে ‘অ্যান্টি এজিং ট্রিটমেন্ট’ করে ভোল পাল্টেছে। |
পার্ক স্ট্রিটের বদলের চিহ্ন হিসেবে গোটা দুনিয়ার শহরগুলিতে জনপ্রিয় কিছুক্ষণ আরামে সময় কাটানোর কফিশপ বা লাউঞ্জের আদলটাই ইদানীং বেশি চোখে পড়ছে।
আজকের দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরি করা কলকাত্তাইয়ারা অনেকেই এই বদলকে স্বাগত জানাচ্ছেন। বেশ ক’বছর আমেরিকায় কাটিয়ে আসার পরে গড়িয়ার বধূ অমৃতা ঘোষ যেমন স্টারবাক্স-এর কফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এ দিন বিকেলে অ বঁ প্যাঁ খোলার পরে সেখানে হঠাৎ ঢুকে ইথিওপিয়াজাত অ্যারাবিকা বিন্স-এর কফিতে চুমুক দিয়েছেন। অমৃতার কথায়, “কলকাতায় বড় হয়ে আমরা অনেক ভালমন্দ খানাই ছোট থেকে চাখার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু সত্যি বলতে কফির স্বাদ চিনতে কলকাতাবাসীর এখনও খামতি আছে। নতুন যুগের কফিশপগুলোর সে-দিক দিয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে।”
অমৃতার সঙ্গী মধ্য তিরিশের আর এক মহিলা স্মিতা অগ্রবালও পার্ক স্ট্রিটের বদলের পক্ষেই সায় দিলেন। তাঁর কথায়, “আগেকার পার্ক স্ট্রিটে কিন্তু মেয়েদের একা আড্ডার চল ছিল না। সত্যি বলতে কলকাতার পুরনো রেস্তোরাঁগুলোয় মেয়েদের একা দেখাই যেত না তেমন। ভাল লাগছে, আজকের পার্ক স্ট্রিটে সবার জন্যই একটা নিজের মতো স্পেস গড়ে উঠছে।” এই ধরনের কফিশপ বলতে কলকাতাবাসীদের অনেকেরই এখন বারিস্তার কথা মনে পড়ে। পার্ক স্ট্রিটে কাফে এবিপি-র উল্টো ফুটে বারিস্তাও দিব্যি বহাল রয়েছে।
যাদের হাত ধরে এই বদল এল কলকাতায় সেই আরপিজি-গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান সঞ্জীব গোয়েন্কাও এটাই যুগধর্ম বলে মনে করছেন। “বিদেশি কফিশপের ঝকঝকে চেহারায় ভারতীয় রুচির কথা মাথায় রাখা হয়েছে। স্বাদ ও স্বাস্থ্য দুটো দিক ভেবে এন্তার স্যালাডের সঙ্গে তেলবিহীন বেক্ড সামোসা, বেক্ড বড়া পাওয়ের মতো পদও থাকছে।” কলকাতার নতুন কফিশপগুলো অনেকেই এখন ঢালাও লাঞ্চ-ডিনারের ব্যবস্থা রাখে। নিজস্ব বেকারির তাজা ক্রোয়াসঁ ও কফির ফরাসি প্রাতঃরাশ ছাড়াও পার্ক স্ট্রিটের নতুন কফিঠেক সবিস্তার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে।
কিছু কিছু পুরনো পার্ক স্ট্রিটপ্রেমী তবু একেলে ‘স্বাস্থ্যকর’ স্যান্ডউইচের চেয়ে সাবেক স্টেক-রোস্টেই শান্তি খুঁজে পান। ষাটের দশকের শেষ দিকে ১৫ বছর বয়স থেকে পার্ক স্ট্রিটে ট্রিঙ্কাজে ড্রাম বাজাতেন নন্দন বাগচী। এখনও সামপ্লেস এল্স-এ গানবাজনা করেন। বললেন, “যুগের হাওয়া মেনে নিতেই হয়। এখন পার্ক স্ট্রিটে অনেকেই আসেন, যাঁরা আগে আসতেন না। বদলটা মানতে তাঁদের সমস্যা নেই। কিন্তু আমার মতো কারও কারও মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ যেন ভ্যান গখের ছবিতে আচমকা ফ্লুরোসেন্ট রং ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।” |