মনের টানে জঙ্গলমহলে গিয়ে তিনি আহত ও অসুস্থ মাওবাদীদের শুশ্রূষা করতেন বলে গোয়েন্দারা আগেই জেনেছেন। এ বার জানা গেল, উগ্র বামপন্থায় ডাক্তার সমীর বিশ্বাসের বিশ্বাস আরও অনেক আগেকার। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি যখন সবে ডাক্তারি শুরু করেন, সেই সময়েই নকশাল আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাঁকে কলকাতায় গ্রেফতার করেছিল। সেটা সত্তরের দশক। চারু মজুমদার, অসীম চট্টোপাধ্যায়দের আহ্বানে তখন বহু মেধাবী ছাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অতি-বাম রাজনীতিতে।
চিকিৎসকের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার তিন বছর পরে সমীরবাবুর বিরুদ্ধে মাওবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে মামলা রুজু করে পুলিশ। সেটা ২০১০-এর এপ্রিল। পুলিশি সন্ত্রাস এবং আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগকে সামনে রেখে তখন জঙ্গলমহলে কিষেণজির নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের তৎপরতা তুঙ্গে।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, গত ১১ ডিসেম্বর আসানসোলে ধৃত রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা সংস্থা ইসিএলের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক সমীরবাবু ছাত্রজীবনেই অতি-বাম রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছিলেন এবং পরবর্তী জীবনেও তা থেকে সরে আসেননি। আর সেই জন্যই লালগড় আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়ে স্বেচ্ছায় জঙ্গলমহলে গিয়ে তিনি আহত ও অসুস্থ মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য ও নেতাদের চিকিৎসা করতেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি। সমীরবাবুর সমসাময়িক অনেকেই অবশ্য ছাত্রজীবনে নকশাল আন্দোলনে প্রবল ভাবে যুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে জানান, তাঁদের ভুল হয়েছিল, তাঁরা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
নকশাল আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে প্রথম বার গ্রেফতার হওয়ার ৩৯ বছর পরে মাওবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে সমীরবাবুর বিরুদ্ধে আসানসোল (উত্তর) থানায় মামলা রুজু হয় ২০১০-এর ১৯ এপ্রিল। তার পর থেকে সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে পালিয়ে বেড়ানোর পরে আসানসোলের মহিশিলা কলোনিতে আত্মীয়ের বাড়িতে ধরা পড়েন তিনি।
রাজ্য পুলিশের একাংশের বক্তব্য, মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে এমবিবিএস পাশ করা কোনও ডাক্তারের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক কালে এই প্রথম।
সমীরবাবুকে দফায় দফায় জেরা করেছে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ (আইবি)। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা পুলিশ জেনে গিয়েছে বুঝেই ২০১০-এর এপ্রিলে ওই চিকিৎসক গা-ঢাকা দেন এবং পালিয়ে বেশ কিছু দিন দিল্লিতেও ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর আশ্রয়দাতার নামও জানতে পেরেছে পুলিশ। গোয়েন্দাদের দাবি, আত্মগোপন করে থাকা অবস্থাতেও সমীরবাবু যাদবপুর ও আসানসোলের দুই বাসিন্দার মাধ্যমে লালগড়ে মাওবাদী মদতে পুষ্ট পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রেসক্রিপশন এবং ওষুধপত্র পাঠাতেন।
আইবি-র বক্তব্য, উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা, প্রাক্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মধুসূদন বিশ্বাসের ছেলে সমীরবাবু ’৬৪-তে এমবিবিএস পড়তে নীলরতনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে পাশ করে বেরোন ’৬৯-এ। পাশ করে বেরোনোর বছরেই তিনি সিপিআই-এমএল পার্টিতে যোগ দেন। বঙ্গবাসী কলেজের এক শিক্ষক ও সিপিআই-এমএল নেতা এবং নীলরতনের কয়েক জন নকশাল ছাত্র তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন বলে গোয়েন্দাদের খবর। সমীরবাবু ’৭১-এ নীলরতনে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। আর সেই বছরের জানুয়ারিতেই কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা তাঁকে গ্রেফতার করেন। ’৭২-এর ২৮ অগস্ট পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে।
আইবি-র এক কর্তার কথায়, “ছাত্রজীবনে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সমীরবাবুর মধ্যে অতি-বাম রাজনীতির প্রতি ঝোঁক থেকেই গিয়েছিল। তাই পরবর্তী সময়ে জঙ্গলমহলের মাওবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।” কিষেণজি এবং অন্য মাওবাদী নেতাদের সঙ্গে তাঁর কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল, সমীরবাবু সেই বিষয়ে গোয়েন্দাদের বিশদ ভাবে কিছু বলেননি। তা জানার চেষ্টা চলছে বলে জানান ওই অফিসার। |