ক্ষমতায় থাকার সময় ছিল ভলভো বাস, বিরিয়ানি। ক্ষমতা হারানোর আড়াই বছর পরে সে জায়গা নিয়েছে লোকাল ট্রেন ও বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় করা রুটি-তরকারি! ঠেকায় পড়ে আবার পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাচ্ছে সিপিএম!
বর্ধমানে মঙ্গলবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জনসভা। সারা জেলা থেকেই কর্মী-সমর্থকেরা যাবেন সেই সভায়। সিপিএম সূত্রে খবর, যাঁরা যাবেন, তাঁদের অধিকাংশই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। গরিব পরিবারের মানুষ। বর্ধমান স্টেশন থেকে বাইপাসের ধারে হারাধনপল্লির জনসভার মাঠের দূরত্ব প্রায় ৬ কিমি। স্টেশন থেকে সেই দীর্ঘ পথ হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক যাবেন মিছিল করে। সে-ও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কাজেই দুপুর ২টো নাগাদ সভায় পৌঁছতে গেলে জেলার প্রান্তিক এলাকা থেকে তাঁদের বেরোতে হবে অন্তত সকাল ৯ টা নাগাদ। ফলে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।
কিন্তু সে দিন আর নাই! রাজ্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন কাঁকসা থেকে এক এক সময় দলের সভা সমিতিতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে যাওয়া হতো ভলভো বাসে করে। অন্য দল তো বটেই, সিপিএমের অন্দরেও কাঁকসার নেতারা সমালোচিত হয়েছিলেন। কিন্তু আজকের সিপিএম সে জায়গাতেই নেই। তার উপরে পঞ্চায়েত ভোটে পর্যুদস্ত এবং বর্ধমান শহরের পুরভোট থেকে প্রার্থী তুলে নেওয়ার জেরে প্রবল সমালোচিত জেলা সিপিএম এখন কোণঠাসা। একে সামর্থ নেই, তদুপরি বাড়তি কিছু করে ফের বিতর্কও ডেকে আনতেও চাইছেন না বর্ধমানের জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। অগত্যা লোকাল ট্রেন আর বাড়ি বাড়ি থেকে নেওয়া রুটি-গুড়-তরকারিই ভরসা! ক্ষমতা হারানোর পরে ২০১২-র প্রথম ব্রিগেড সমাবেশেও ঠিক যে পথ নিতে দেখা গিয়েছিল সিপিএমকে।
অবস্থা এখন এমনই, মঙ্গলবারের জনসভায় যাওয়ার জন্য সাধারণ বাস ভাড়া করতে পারছে না আজকের সিপিএম। দুর্গাপুরের এক দলীয় নেতার কথায়, “বাস পিছু গড়ে ৫ হাজার টাকা ভাড়া। পার্টির ক্ষমতা নেই।” অথচ এক সময় সমালোচনা ছিল, দুর্গাপুরের এক কয়লা-মাফিয়ার সৌজন্যে সিপিএম কর্মীদের নিয়ে ভলভো ছুটত সভার উদ্দেশে! দলের নেতৃত্ব অবশ্য কোনও দিনই কয়লা মাফিয়াদের সঙ্গে দহরম মহরমের কথা স্বীকার করেননি। আর এখন তো প্রশ্নই নেই! লোকাল ট্রেন বোঝাই হয়ে মঙ্গলবার বর্ধমান স্টেশনে নামবেন সিপিএম সমর্থকেরা। জেলার প্রান্তিক এলাকার জন্য কিছু বাস, লরি, ট্রাকের ব্যবস্থা অবশ্য রাখতেই হচ্ছে।
রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার শেষ কয়েক বছরে সিপিএমের বহু সভা-সমিতিতেই খাদ্য তালিকা আলো করত বিরিয়ানি। বা কোথাও কোথাও খাবারের ভাল প্যাকেট। কিন্তু মঙ্গলবারের সভার জন্য কর্মী-সমর্থকদের হাতে সেই সাতের দশকের মতোই রুটি-তরকারি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বর্ধমান জেলা নেতৃত্ব। বিভিন্ন এলাকায় দলীয় কর্মীদের বুথ ভিত্তিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসভায় যাওয়ার আহ্বান এবং মঙ্গলবার সকালে রুটি-তরকারি রান্না করে দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছেন। রুটি-তরকারির পরিবর্তে কেউ টাকা দিতে চাইলে নেওয়া হচ্ছে না। দুর্গাপুরের বিধাননগর-জেমুয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক পঙ্কজ রায় সরকারের কথায়, “টাকা নিলে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠার সম্ভাবনা থাকে। অতীতে বহু ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে।”
দলের প্রবীণ কর্মীরা জানাচ্ছেন, ক্ষমতায় আসার আগে পার্টির হাতে অর্থ ছিল না। সাহায্য চেয়ে পার্টির কাজকর্ম চলত। রেওয়াজ ছিল সভা-সমিতিতে আগত পার্টি কর্মীদের জন্য রুটি-তরকারি রান্না করে দেওয়া। সেই রুটি-তরকারি খেয়ে প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুদের ভাষণ শুনতে বসতেন কর্মী-সমর্থকেরা। দলের এক জেলা নেতা বলেন, “এর একটা অন্য দিক হল, পার্টির সঙ্গে আরও একাত্ম হওয়ার সুযোগ। পাশাপাশি জনসংযোগও ঝালিয়ে নেওয়া যায়।” সিপিএম সূত্রের খবর, ৬০-৬৫ হাজার রুটি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। তা ছাপিয়ে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। গ্রাম এলাকায় মুড়ি, গুড়, শসা ইত্যাদি সংগ্রহের প্রক্রিয়াও চলছে। দুর্গাপুর শহরের বর্ষীয়ান এক সিপিএম কর্মীর বক্তব্য, “ক্ষমতায় আসার পরেও বেশ কয়েক বছর এ ভাবেই খাবারের ব্যবস্থা হত। বিরিয়ানি বা ভলভো বাসের ব্যবস্থা চালু হওয়ার সময়েও অনেকে বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কথা তখন কেউ শোনেনি। আজ ঠ্যালায় পড়ে পুরনো পথই নিতে হচ্ছে!”
বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বর্ধমানে প্রায় ৪৫% ভোট পাওয়ার পরেও দুর্গাপুর পুরসভা হাতছাড়া হয়েছে বামেদের। পঞ্চায়েতে হার এবং বর্ধমানের পুরভোটে প্রার্থী তুলে নেওয়ার বিতর্কের জেরে জেলা নেতৃত্বে পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে। এমন অবস্থায় রুটি-তরকারিতে ফিরে গিয়ে কি জনসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন জেলা নেতারা? সরাসরি কিছু না-বলেও জেলা সম্পাদক অমল হালদারের বক্তব্য, “বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে থাকি। এটাও তেমন আর একটা সুযোগ।” |