রাজ্যের চাপে গ্রামে ঋণ দেওয়া বাড়াল ব্যাঙ্ক
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এ রাজ্যের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাষি বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে চাহিদামতো ঋণ দেয় না, এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু নতুন সরকারের আমলে ছবিটা ক্রমেই পাল্টাচ্ছে বলে দাবি রাজ্যস্তরের ব্যাঙ্কগুলির কমিটির (স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটি বা এসএলবিসি)। আগামী আর্থিক বছরে সামাজিক ক্ষেত্রে ঋণ, অনুদান এবং সহায়তার পরিমাণ কী ভাবে আরও বাড়ানো যায়, তা খতিয়ে দেখতে আজ সোমবার রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে তারা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ঋণ কতটা সুলভ, তার উপরে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে। ঋণ সহজে মিললে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়। রোজগারের সুযোগ বাড়ে। কিন্তু সেই বাম আমল থেকেই অভিযোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি এ রাজ্যে যতটা আমানত সংগ্রহ করে, সেই অনুপাতে যথেষ্ট ঋণ দেয় না। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন অসীম দাশগুপ্ত এ নিয়ে বহু বার ব্যাঙ্কগুলিকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
নতুন জমানায় ছবিটা পাল্টাল কী করে? রাজ্যের ‘লিড ব্যাঙ্ক’ ইউবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, গ্রামীণ স্তরে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার সব চেয়ে বড় অসুবিধা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয়। রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেক সময়ই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। প্রশাসনও ব্যাঙ্কগুলিকে সহায়তা করে না। কিন্তু গত ক’বছরে রাজ্য সরকার তৃণমূল স্তরে দলতন্ত্রমুক্ত প্রশাসন গড়ার উপরে জোর দিয়েছে। তার ফলেই বেড়েছে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ দেওয়ার পরিমাণ।
সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলির অংশগ্রহণ যে বেড়েছে, তা গত এক বছরে তাদের দেওয়া ঋণ এবং সংগৃহীত আমানতের অনুপাতের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে। রাজ্য অর্থ দফতর সূত্রের খবর, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে আমানত বৃদ্ধির থেকে ঋণের বৃদ্ধির হার দু’শতাংশ বেশি। গত আর্থিক বছরের ঋণ-আমানতের অনুপাত ছিল ৬৫%। চলতি বছরে এখনই তা বেড়ে হয়েছে ৬৬ শতাংশ। বাম আমলে মাত্র এক বার, ২০০৬-’০৭ আর্থিক বছরে ঋণ-আমানত অনুপাত এই মাত্রা ছুঁয়েছিল। অর্থ দফতরের কর্তাদের আশা, এ বার বছর শেষে অনুপাত ৭০%-এ পৌঁছে যাবে।
ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ক্ষমতায়ন বলে ব্যাখ্যা করছেন রাজ্য অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকার। তাঁর কথায়, “অনুন্নত এলাকায় ঋণের পরিমাণ বাড়লে রাতারাতি অর্থনীতি বদলে যাবে, এমনটা নয়। কিন্তু অনুন্নত জেলায় ঋণ-আমানত অনুপাত বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্যই হল, সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ক্ষমতায়ন। পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ ঋণ পেলে তাঁদের জীবনযাত্রার মানও বাড়বে।”
অভিরূপবাবুর এই যুক্তি অবশ্য মানছেন না রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর অভিযোগ, “ছোট চাষি বা ব্যবসায়ী মোটেই এই সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে বড় চাষি, জোতদারেরা। তাদের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্যই ব্যাঙ্কগুলির উপরে চাপ দিচ্ছে সরকার। আর ছোট চাষিরা জোতদারের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।” সূর্যবাবুর এই অভিযোগ উড়িয়ে সরকারের তরফে পাল্টা বলা হচ্ছে, ঋণ-আমানত অনুপাত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ রাজ্যের ৯টি অনুন্নত জেলায় ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়া। ওই জেলাগুলিতে বড় চাষি, জোতদার বা বড় ব্যবসায়ী কোথায়!
এসএলবিসি-র এক কর্তাও জানাচ্ছেন, ২৬ অগস্ট শেষ যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে ৪০%-র কম ঋণ-আমানত অনুপাত রয়েছে, এমন ন’টি জেলার উপরে বাড়তি জোর দিতে বলেছিল রাজ্য সরকার। ওই জেলাগুলিতে গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, জলপাইগুড়ির মতো পিছিয়ে পড়া জেলাগুলিতে ঋণ-আমানতের অনুপাত উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। কোথাও কোথাও সেই অনুপাত বৃদ্ধির হার ৬%-র কাছাকাছি। ওই কর্তা বলেন, “সরকার প্রত্যন্ত জায়গায় আমাদের শাখা খোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে আমানত যেমন বাড়ছে, তেমনই কৃষিঋণের আওতায় নতুন নতুন পরিবারও আসছে।”
গত জুন মাস থেকে ঋণ-আমানতের অনুপাত ৫% বেড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “সারদা কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা। তার পরে ওই জেলায় ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি খুবই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।” তবে এত কিছু সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত এ রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ সে ভাবে বাড়েনি। সোমবার বৈঠকে এ ব্যাপারে ব্যাঙ্কগুলিকে অনুরোধ করবে রাজ্য। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, “এ রাজ্যে ব্যাঙ্কগুলির অংশগ্রহণে আমরা খুশি। তবে আশা করব, সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্কগুলি তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে।”
পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া হিসেবে কৃষকদের মধ্যে কিষান ক্রেডিট কার্ড বিলির উপরেও বাড়তি জোর দিচ্ছে রাজ্য সরকার। অর্থ দফতরের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ কিষান ক্রেডিট কার্ড বিলি করা হয়েছিল। চলতি বছরে ১৫ নভেম্বর সেই সংখ্যা ছ’লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, “রবিশস্যের সময়ে কিষান ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা বাড়ে। আমাদের আশা, চলতি আর্থিক বছরে কিষান ক্রেডিট কার্ডের লক্ষ্যমাত্রা ১২ লক্ষ ছুঁতে না পারলেও তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারব।” ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রাজ্য অনেকটাই এগিয়েছে বলে দাবি ওই কর্তার। তিনি জানান, গত আর্থিক বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ বার তা প্রায় ২০% বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
রাজ্যের দেড় লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়ার পরিমাণও বাড়িয়েছে ব্যাঙ্কগুলি। অর্থ দফতর সূত্রের খবর, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে ৩৩ হাজার ২৯৯টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ৬২ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। যেখানে গত আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে ৩০ হাজার ২৫৫টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ৪৬ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। তবে এই ঋণের পরিমাণ জাতীয় গড়ের (৮৩ হাজার টাকা) তুলনায় কম।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.