আর্থিক বছরের ৯ মাস কাটতে চলেছে। বছরের তিন ভাগ পেরিয়ে এসে তাঁর সরকারের ৫৮টি দফতর কে কেমন কাজ করল, তার খোঁজখবর নিতে শুক্রবার টাউন হলে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রের খবর, কয়েকটি দফতরের কাজে খুশি হলেও কিছু দফতরের আধিকারিকেরা যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি। ঢিলেঢালা মনোভাব দেখানোর জন্য আমলাদের তিরস্কারও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের সামনে অবশ্য মমতা বলেন, “চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছি। বাম জমানার ঋণ আর সুদ মেটাতেই টাকা চলে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরেও ১৫ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন খাতে খরচ হয়েছে। রাজস্ব আদায় ৩২% বেড়েছে। এর মধ্যে দাঁড়িয়েও সব দফতরই ভাল কাজ করছে।”
কিন্তু বৈঠকে যে মুখ্যমন্ত্রী সব দফতরের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেননি, তা জানাচ্ছেন সরকারের একাধিক সূত্রই। তার মূল কারণ, বরাদ্দ অনুযায়ী টাকা খরচ করতে না-পারা। অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, ২০১৩-’১৪ সালের বাজেটে ২৬ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা পরিকল্পনা ব্যয়ের কথা ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। অথচ প্রায় ন’মাস পরে দেখা যাচ্ছে, খরচ হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের ৫৬ ভাগ। বাকি তিন মাসে ৪৪% টাকা খরচ করা খুবই কঠিন। তবু উন্নয়নের টাকা খরচে যাতে গতি আসে সেই জন্য মুখ্যমন্ত্রী এ দিন পিছিয়ে থাকা দফতরগুলির সমালোচনা করেছেন বলে নবান্ন সূত্রের মত। |
পাশাপাশি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা খরচ করেছে যে সব দফতর, তাদের আধিকারিকেরা তারিফ কুড়িয়েছেন। যেমন, প্রথম ৯ মাসের জন্য উন্নয়ন খাতে যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে তার ১২৫% খরচ করে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা কুড়িয়েছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। তাঁরই হাতে থাকা পঞ্চায়েত দফতর খরচ করেছে ১১১%। গৌতম দেবের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের কাজেও মুখ্যমন্ত্রী খুশি। মলয় ঘটকের কৃষি দফতর, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের খাদ্য দফতর এবং সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের পূর্ত দফতর এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর বাহবা পেয়েছে।
এরই পাশাপাশি, পরিকল্পনা খাতের টাকা খরচে ঢিলেমির জন্য আবাসন, পুর, শিক্ষা, শিল্প, সেচ, নারী কল্যাণ ও প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীর মৃদু ধমক খেয়েছেন। মমতা তাঁদের বলেছেন, এখনও সময় রয়েছে। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
জমি ও শিল্প সংক্রান্ত ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য শিল্পপতিদের যাতে অপেক্ষা করতে না-হয়, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রী এ দিন শিল্পসচিব চঞ্চলমল বাচোয়াতকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই শিল্পায়নের প্রতি মমতার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। মুম্বইয়ে গিয়ে মুকেশ অম্বানি-সহ দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করে যার সূত্রপাত। এর পর তাঁর সরকারের শিল্পনীতি ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, প্রতিটি শিল্প প্রস্তাবের জন্য কর্পোরেট ধাঁচ মেনে নিয়োগ করা হবে আলাদা আলাদা রিলেশনশিপ ম্যানেজার। ২১ দিনের মধ্যে শিল্প প্রস্তাবে ছাড়পত্র দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছে সরকার। শিল্পসচিবকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ সেই অঙ্গীকার পূরণের অঙ্গ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
তবে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই রাজ্যের শিল্পচিত্র পাল্টে যাবে, এমনটা মনে করছেন না শিল্পপতিদের একটা বড় অংশ। তাঁদের মতে, এ রাজ্য শিল্প স্থাপনে মূল প্রতিবন্ধক জমি। বেসরকারি শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ না করার নীতি নিয়েছে মমতার সরকার। সেই নীতির বদল না-হলে রাজ্যে লগ্নি আসা কঠিন। এর পাশাপাশি শিল্প দফতরের স্বাধীন ভাবে কাজ করার ক্ষমতা না-থাকাটাও লগ্নি টানার পথে অন্যতম অন্তরায় বলে মনে করছেন ওই শিল্পপতিরা। তাঁদের বক্তব্য, লগ্নিকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে শিল্প দফতরের কর্তাদের কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেখাতে হয়। কিন্তু শিল্প স্থাপনের প্রশ্নে আমলারা পুরোপুরি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী। |
তৃণমূল সূত্রে অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, গরিব মানুষের কাছ থেকে জোর করে জমি না-কাড়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। সেই অবস্থানের মধ্যে থেকেই আমলারা কাজ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। সরকারের নীতির মধ্যে থেকে আমলারা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন বলে ওই সূত্রের দাবি।
শিল্পের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের কাজ নিয়েও এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকল্পে বাড়ি তৈরির কাজে তেমন অগ্রগতি না-হওয়ায় আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে সতর্ক করেন তিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা দফতরে কেন আশানুরূপ টাকা খরচ হয়নি, তা জানতে চান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও সচিব অর্ণব রায়ের কাছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেন অধিগৃহীত সংস্থা বিষয়ক দফতরের কাজেও।
আইসিডিএস প্রকল্প এবং সরকারি হোমগুলির বেহাল দশা নিয়েও এ দিন উষ্মা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দফতরের সচিব রোশনি সেন তাঁকে বলেন, কেন্দ্রের টাকা না আসায় রাজ্যের ম্যাচিং গ্রান্টের টাকা খরচ করা যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী খানিকটা অসন্তোষের সুরেই তাঁকে এ বিষয়ে মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন।
মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতে থাকা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সচিব অত্রি ভট্টাচার্যও এ দিন ধমক খেয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, দফতরে কাজের থেকে কথা বেশি হচ্ছে। শুধু গান আর মেলা করলেই চলবে না, পরিকল্পনা খাতের টাকাও খরচ করতে হবে। অত্রিবাবুর মতোই মুখ্যমন্ত্রীর ধমক শুনেছেন বন ও মৎস্যসচিব সুবেশ দাস, পরিবেশসচিব ত্রিলোচন সিংহ, পর্যটনসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন। দমকলসচিব রমেশ কুমারের কাছে কাজের হিসেব চাওয়া হলে তিনি কোন কোন ফাইল অর্থ দফতরে অনুমোদনের জন্য আটকে রয়েছে, তা জানান। এ নিয়ে বৈঠকে বেশ কিছু ক্ষণ চাপান-উতোর চলে।
এ বারের বৈঠকে মন্ত্রীদের থেকে সচিবরাই বেশি বকাঝকা খেয়েছেন দেখে এক প্রশাসনিক কর্তার কটাক্ষ, “গত কয়েক মাসে বেশ কিছু অফিসার মন্ত্রীদের এড়িয়ে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করছিলেন। এ বার তাই ধমকও সরাসরি তাঁরাই খাচ্ছেন!”
তবে এই ধমকের মূল উদ্দেশ্য প্রশাসনে গতি আনা বলেই দাবি করছে শাসক দল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছেন, “দগদগে ঘা থাকা অবস্থায় একটা সরকার পেয়েছি। সেই সব ঘা সারিয়ে একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, এখন থেকে সাত দিন অন্তর সচিবদের উন্নয়নমূলক কাজের পর্যালোচনা করতে হবে। আর মন্ত্রীরা হিসেব নিতে বসবেন ১৫ দিন অন্তর। |