পাহাড়ের বরফ গলে জল হয়ে গেল নবান্নে
ছরের শুরুতে অশান্তি শুরু হয়েছিল পাহাড়ে। ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ অবস্থান নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্ধ, অগ্নিসংযোগ, অবরোধ, বিমল গুরুঙ্গের জিটিএ- প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা সত্ত্বেও অবস্থান পাল্টাননি মুখ্যমন্ত্রী। তারই যেন ফল মিলল। সেই গুরুঙ্গই ফিরছেন ফের জিটিএ-প্রধানের পদে। শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে কার্যত নিজেই তা ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি। এবং জানিয়ে দিলেন ‘মধুর সমাপ্তি’-ই হতে চলেছে পাহাড়-বিতর্কের। আপাতত ‘গোর্খাল্যান্ড’-এর দাবি কিংবা কোনও বিবাদের রাস্তায় তাঁরা এখনই হাঁটবেন না। বরং, পর্যটনে জোর দিয়ে আরও উন্নয়ন ও জেলবন্দি সতীর্থদের দ্রুত ছাড়ানোই তাঁদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে।
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বিমল জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে ফের জিটিএ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। রাজভবনে এসে শপথ নেবেন আগামী বৃহস্পতিবার। রাজ্য সরকারের প্রস্তাব মতো পাহাড়ে দ্বিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর বিষয়টিও তাঁরা মেনে নিচ্ছেন।
রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের সঙ্গে এ ভাবে বিরোধের মধুর সমাপ্তি ঘোষণা করা নিয়ে গুরুঙ্গের ভাষ্যটি এই রকম: ঘরের সমস্যা ঘরেই মিটিয়ে ফেলতে হয়। তিনি সেটাই করেছেন। এ নিয়ে অবশ্য কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না সিপিএম ও পাহাড়ের মোর্চা-বিরোধী দলগুলি। তবে মোর্চা সূত্রের খবর, দলের বন্দি নেতা-কর্মীদের মুক্তিই এখন তাদের প্রথম লক্ষ্য। গুরুঙ্গও এ ব্যাপারে রাখঢাক না রেখে এ দিন বলেন, “এখন তো সব মিটমাট হয়ে গিয়েছে। আর বিবাদ নয়। তা হলে আমাদের নেতা-কর্মীরা দু’চার দিনে মুক্তি পাবেন, এমন আশা করতেই পারি।” ২৬ তারিখ রাজ্যপাল কে আর নারায়ণন গুরুঙ্গকে শপথবাক্য পাঠ করানোর আগেই তা হবে বলে আশা করছেন গুরুঙ্গ।

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিমল গুরুঙ্গ। ছবি: প্রদীপ আদক।
এ দিন বিকেল তিনটে নাগাদ নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে আসেন মোর্চা প্রধান। সঙ্গে ছিলেন রোশন গিরি, রাম ভুজল, বিধায়ক তিলক দেওয়ান এবং জিটিএ-র ডেপুটি চেয়ারম্যান রমেশ অ্যালে। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রথমে মিনিট কুড়ি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন মোর্চা-প্রধান। সেখানেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ফের জিটিএ-প্রধান হওয়ার অনুরোধ করেন। বৈঠকের পরে গুরুঙ্গ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমাকে জিটিএ-র দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছেন। এখন জিটিএ ভাল ভাবে চালাতে হবে। ২৬ ডিসেম্বর রাজভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। দার্জিলিঙের মানুষজনের যাতে ভাল হয় তার জন্যই আমাকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।”
গত কয়েক মাসের তিক্ততার পর্ব নিয়ে মোর্চা সভাপতিকে বারবারই বলতে শোনা যায়, “পরিবারে বাবা-মা-ভাই-বোনের মধ্যে গোলমাল হয়েই থাকে। আমাদের মধ্যেও হয়েছে। ঘরের সমস্যা ঘরের মধ্যেই মিটিয়ে নিতে হয়।” সেই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, “আমি ও মুখ্যমন্ত্রী, দু’জনেই চাই জিটিএ-র উন্নয়ন। মাঝেমধ্যে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা চাইছি জিটিএ ঠিক পথে এগিয়ে যাক।”
মোর্চার অন্দরের খবর, এত দিন দিল্লির মুখাপেক্ষী হলেও চার রাজ্যের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ফল দেখার পর রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে ফের সুসম্পর্ক গড়ার জন্য চাপ তৈরি হয়েছে মোর্চার অন্দরেই। তৃণমূল নেত্রীও চান, পাহাড়ে কোনও সমস্যা হলে রাজ্যের মধ্যেই তা মিটিয়ে নিতে হবে। কারণ, পাহাড় রাজ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই দু’টি বিষয় মাথায় রেখেই রাজ্যের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তায় হাঁটার বার্তা গুরুঙ্গ দিয়েছেন বলে দাবি মোর্চা নেতৃত্বের একাংশের।
কিছু দিন আগে পর্যন্তও জিটিএ চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে মোর্চা। কিন্তু কেন্দ্রে আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত জিটিএ এলাকায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গঠন করা সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার তাই প্রথম থেকে মোর্চা নেতৃত্বকে জানিয়ে দিয়েছিল, আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া যেমন চলছে চলুক। আপাতত দ্বিস্তর পঞ্চায়েত ভোট করে তৃণমূল স্তরে উন্নয়নের কাজ শুরু করুক জিটিএ। শেষমেশ রাজ্য সরকারের মতই মেনে নিলেন জিটিএ প্রতিনিধিরা। এখন গুরুঙ্গের যুক্তি, “এখন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোট করতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ৫-৭ বছর লেগে যাবে। আপাতত তাই দ্বিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়েই এগোতে হবে।”
গুরুঙ্গের এ দিনের ঘোষণা সম্পর্কে পাহাড়ের বিরোধী দলগুলির একাংশের বক্তব্য, পাহাড়বাসীর আবেগ নিয়ে ছেলেখেলা করেছেন গুরুঙ্গ। বিরোধী দলের একটি অংশ আবার বলছে, লোকসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেই সরকারের সঙ্গে হাত মেলানোর পথে হাঁটলেন মোর্চা নেতৃত্ব। গোর্খা লিগের মুখপাত্র প্রতাপ খাতি বলেন, “গুরুঙ্গ আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি রাজ্য সরকারের কথাতেই চলবেন। তবে পদ ছাড়ার নাটক কেন করলেন, এর জবাব তাঁকে দিতে হবে। সুবাস ঘিসিং-ও অতীতে পাহাড়ের মানুষকে একই ভাবে বোকা বানিয়েছিলেন।”
সিপিআরএম-এর মুখপাত্র গোবিন্দ ছেত্রীর কটাক্ষ, “যা বোঝা যাচ্ছে, পাহাড়ে জিটিএ ও পঞ্চায়েত দু’টিই রাজ্য সরকারের কথায় চলবে।” সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের কাছে এই ঘটনা অপ্রত্যাশিত নয়। তাঁর মন্তব্য, “মোর্চা ও তৃণমূলের সম্পর্ক যে অনেক গভীর তা আমরা বরাবরই বলছি। লোকসভা ভোটের আগে সেটা আরও স্পষ্ট হল।”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “লোকসভা বা বিধানসভা বলে কোনও কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী সব সময়ই চান পাহাড় শান্তিতে থাকুক। উন্নয়ন হোক। পাহাড়-সমতল মিলেমিশে থাকুক।”
বস্তুত, জিটিএ গঠনের পর থেকে রাজ্যের তরফে মোর্চার কাছে পাহাড়ের উন্নয়নকেই প্রধান গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বারবার বার্তা দেওয়া হয়েছে। রাজ্যও যে পাহাড়কে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বোঝাতে গত ২৯ জানুয়ারি উত্তরবঙ্গ উৎসবের প্রধান অনুষ্ঠানও দার্জিলিঙে হয়। ঘটনাচক্রে সে দিন মুখ্যমন্ত্রী যখন বক্তব্য রাখছিলেন, সে সময়ে মঞ্চের সামনে থেকে গোর্খাল্যান্ডের দাবি ঘনঘন স্লোগান ওঠে। তাতে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী মাইকে নিজেকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ বলে ঘোষণা করে কার্যত ওই স্লোগান থামাতে বাধ্য করেন। এর পরেই মোর্চা ও তৃণমূলের সম্পর্কের অবনতি হয়। জুলাইয়ের শেষে কেন্দ্রের পৃথক তেলঙ্গানা গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্তের পরে গুরুঙ্গরা লাগাতার পাহাড় বন্ধে নামেন। রাজ্যের কয়েক জন কংগ্রেস নেতার সহযোগিতায় দিল্লিতে গিয়ে ফের পৃথক রাজ্যের দাবিতে দরবারও শুরু করেন মোর্চার নেতারা। এতে বেজায় চটেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল ও মোর্চার সম্পর্ক খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ায়।
এর পরে জিটিএ প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন গুরুঙ্গ। রাজ্য পত্রপাঠ তা গ্রহণ করে। পাহাড়ে আধা-সামরিক বাহিনী পাঠানো হয়। কয়েক দফায় প্রায় ৪২ দিন পাহাড় কার্যত অচল থাকে। ইতিমধ্যে ১২ জন জিটিএ সদস্য-সহ ১৫০০ মোর্চা নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। বন্ধের মধ্যেই পাহাড়ে গিয়ে লেপচাদের সভায় যোগ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাহাড়ে বন্ধ-বিরোধী আওয়াজ ওঠে। রাজ্য প্রশাসনের তরফেও সমান ভাবে চাপ বাড়ানো হতে থাকে। পাহাড়ের নানা রাজনৈতিক দলের লোকজনকে কাছে টেনে তৃণমূল সংগঠন গড়তে শুরু করে। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ে বন্ধের রাস্তা থেকে সেপ্টেম্বরে কার্যত সরতে বাধ্য হন গুরুঙ্গ। সেই সময়ে জেলবন্দি বিনয় তামাঙ্গকে জিটিএ-চিফ পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় মোর্চা। কিন্তু জামিন না পাওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি শপথ নিতে পারেননি। তখনই গুরুঙ্গকে জিটিএ প্রধান পদে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। তিন দিন আগে গুরুঙ্গ নিজেও সে কথা দার্জিলিঙে ইঙ্গিত দেন।
কিন্তু গুরুঙ্গের ঘনঘন নিজের অবস্থান বদলের একাধিক নজির রয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে গুরুঙ্গ স্পষ্ট ভাবে সে কথা ঘোষণা করবেন কি না, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেরই কৌতূহল ছিল।
আপাতত কৌতূহলের অবসান। কিন্তু পাহাড়ের নাম দার্জিলিং, যেখানে কখনও রোদ, কখনও কুয়াশা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.