বিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যক্রম কী হইবে, ঠিক করিতে অভিভাবকরা আসিবেন। তাঁহারা যাহা বলিবেন, তাহার ভিত্তিতে তাঁহাদের সন্তানরা শিক্ষালাভ করিবেন। আদর্শ গণতন্ত্র বলিতে নিশ্চয়ই এমনটাই বুঝায়। অন্তত তেমনটাই বুঝাইয়া দিয়াছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁহার দফতর। মানুষের দল, মানুষের সরকার, মানুষের বিদ্যালয়, মানুষেরই ছানাপোনা, সুতরাং ছেলেমেয়েদের স্কুলের পাঠ্যক্রম স্থির করিয়া দেওয়া তো মানুষের, মার্জনা করিবেন, অভিভাবকের স্বাভাবিক অধিকার। মৌলিক অধিকারও হইতে পারে, বিচিত্র নহে। প্রশ্ন একটিই। এমতাবস্থায় ব্রাত্যবাবুর দফতরের পাঠ্যক্রম কমিটির প্রয়োজন কোথায়? এতগুলি লোককে খামকা কষ্ট এবং মাহিনা না দিয়া অভিভাবকদের ডাকিয়া ব্যালট-মাফিক ইতিহাস-পাঠ্য বিজ্ঞান-বিষয় বাংলা-পদ্য ইংরাজি-গদ্য বাছিয়া লইলেই ভাল হয় না কি? অর্থের সাশ্রয় হয়, গণতন্ত্রেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ভারতে ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’র মহিমা বাড়িতেছে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দফতর সেই ময়দানে অবতীর্ণ হইতে পারেন, সিলেবাস ইত্যাদি তৈয়ারির জন্য অভিভাবকদের মতামত এস এম এস যোগে জানিয়া লইতে পারেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল যুগপৎ তৃপ্ত এবং শঙ্কিত হইবেন।
বিদ্যালয় স্তরে যৌনশিক্ষা চালু করা হইবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য: এমন একটি বিষয়ে অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া বুঝিয়া তবেই সরকার এই বিষয়ে অগ্রসর হইবে। এই ‘যুক্তি’র প্রতি-বক্তব্য দুইটি। এক, কোন যুক্তিতে শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষার মান স্থির করিবেন অভিভাবকরা, কিংবা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সমাজের অন্য ব্যক্তিরা? কাহারা সেই ‘অন্যান্য’ ব্যক্তি, যাঁহাদের উপর এতটা ভরসা রাখা হইতেছে? এতই ভরসা-যোগ্য হইলে তাঁহাদের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে রাখা হয় নাই কেন? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর শিক্ষাক্ষেত্রে কয়েক জন প্রতিনিধিস্থানীয় বিচক্ষণ বিষয়বিদকে লইয়া বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হইবে, এমনই স্থির হইয়াছিল, এবং নীতির প্রশ্নে ইহা যথেষ্ট সঙ্গতও ছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করিতেছেন, এমনও শোনা যাইতেছে। তবে আবার এখন ‘অন্যান্য’ ব্যক্তি ও অভিভাবকদের লইয়া টানাটানি কেন? যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তো বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদরাই আলোচনা করিতে পারেন!
দ্বিতীয় বক্তব্য, যৌনশিক্ষা লইয়া আরও কত কাল ‘আলোচনা’র অপেক্ষায় থাকিতে হইবে? নূতন শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রায় মধ্যভাগ: এখনও কিশোরকিশোরীদের প্রয়োজনীয় যৌন-শিক্ষা দিবার প্রশ্নে এত দ্বিধা? বিশেষত, যৌন অপরাধ-কণ্টকিত এই সময়কালে যে এই শিক্ষার একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তার যুক্তিও রহিয়াছে, তাহা এখনও অস্বীকার করা হইবে? বস্তুত, গত এক বছরে মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা প্রতিরোধের উপায় খুঁজিবার সূত্রে স্কুল স্তরে যথাযথ যৌন শিক্ষার প্রয়োজনের কথা বারংবার বলা হইয়াছে। শিক্ষামন্ত্রী তথা সংশয়বাদীদের সমস্যাটি, অনুমান করা যায়, ক্লাসঘরে যৌনবিষয় পঠনপাঠনের কুণ্ঠাপ্রসূত। মাস্টারমহাশয়, দিদিমণি এবং অভিভাবকরা অনেকেই বোধ করি এখনও কুণ্ঠা দূর করিতে পারেন নাই। তাহা অস্বাভাবিক নহে। দীর্ঘদিনের লালিত মানসিকতা সহজে দূর হয় না। সেই কারণেই এই সব ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মন রাখিয়া চলিবার নীতিটি বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। যথার্থ নেতৃত্বের কাজ জনমত অনুসরণ করা নয়, জনমত নির্মাণ করা। শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁহার সরকারকে স্থির করিতে হইবে, সেই কর্তব্য সম্পাদনের সাহস তাঁহাদের আছে কি না। |