দমদম পার্কের পানশালা কাণ্ডের তদন্তে নেমেও কার্যত অন্ধকারেই হাতড়াচ্ছেন তদন্তকারীরা। অভিযোগ দায়ের হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তকারী অফিসারদের সূত্রে জানা গিয়েছে, পানশালার ভিতরের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখেও বিশেষ কোনও সূত্র মেলেনি। বরং আরও কিছু ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
মাধব দাস নামে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগকে ঘিরে শনিবার সন্ধ্যায় ওই পানশালায় ভাঙচুর চালায় ক্ষিপ্ত জনতা। পানশালাটি যে-বাড়িতে, তার একতলায় একটি বৈদ্যুতিন সামগ্রীর দোকান এবং বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মোটরবাইকও ভাঙচুর হয়। মাধবের পরিবার দমদম থানায় অভিযোগ করে, পানশালার বাউন্সারদের মারধরেই ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। শর্ট স্ট্রিটের বিতর্কিত জমি-বাড়িতে দখলদারির হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই বাউন্সারের মৃত্যুর এক মাসের মাথায় ফের অভিযোগ উঠল বাউন্সারদের বিরুদ্ধে।
শর্ট স্ট্রিটের জমিতে বারবার হামলা হওয়া সত্ত্বেও শেক্সপিয়র সরণি থানা যথাসময়ে ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। একই ভাবে দমদমের ওই পানশালার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে দমদম থানার বিরুদ্ধে। রবিবার ওই থানার অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে মাধবের পরিবারও। মাধবের জামাইবাবু সুভাষ মণ্ডল বলেন, “শুক্রবার পুলিশের কাছে গেলেও অভিযোগ নেওয়া হয়নি।” যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কর্তারা জানান, এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখা হবে। |
শোকবিহ্বল। পানশালার ঘটনায় মৃত মাধব দাসের স্ত্রী কণিকা।
দমদমের বাড়িতে, ছেলে আকাশ ও মেয়ে বৃষ্টির সঙ্গে। ছবি: শৌভিক দে। |
পুলিশ জানায়, শনিবার রাতে মাধবের পরিবার অভিযোগ জানানোর পরেই শুরু হয় তদন্ত। খতিয়ে দেখা শুরু হয় সিসিটিভি-র ফুটেজ। রবিবার সকালে পানশালার পক্ষ থেকে আনন্দবাজারের হাতেও সিসিটিভি-র ফুটেজ তুলে দেওয়া হয়। গোটা ঘটনা কী ভাবে ঘটেছে, ওই ফুটেজে অবশ্য সেটা খুব পরিষ্কার নয়। একই মত তদন্তকারীদেরও। তাঁরা জানান, মাধব দোতলা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন বলে পানশালার কিছু কর্মী জানান। কিন্তু ওই যুবক কী ভাবে পড়ে গিয়েছিলেন, তার কোনও ছবি ওই ফুটেজে নেই। ক্যামেরার লেন্সের উপরে সরাসরি আলো পড়ায় সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটিও একটা কালো ছায়ার মতো দেখাচ্ছে। সিঁড়ির পুরো অংশটা ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। পানশালার কর্মীরা অবশ্য এ দিনও দাবি করেন, মাধব নিজেই সিঁড়ি থেকে হড়কে পড়ে যান। তবে কী ভাবে হড়কে গেলেন, তাঁরা তা জানেন না। পানশালার বাউন্সার মহম্মদ আনিসুল জামাল বলেন, আমাদের পানশালায় আট জন বাউন্সার রয়েছেন। কেউ বেশি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে তাঁকে বাইরে বার করে দেওয়াই তাঁদের কাজ। কারও গায়ে হাত দেওয়া যাবে না বলে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে।”
জাহাঙ্গির মল্লিক নামে ওই পানশালার আর এক বাউন্সার জানান, মাধব টলতে টলতে অফিসঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে ফেলেন। কিন্তু সিঁড়ির কাছে যাওয়ার পরে মাধব হাত ছাড়িয়ে নেন। তার পরে জাহাঙ্গির অন্য এক ক্রেতার বিল নিতে চলে যান। কিন্তু সিসিটিভি-র ক্যামেরায় যে-ভাবে মাধবের পড়ে যাওয়ার ছবি ধরা পড়েছে, তাতে তিনি নিজেই যে পা হড়কে পড়ে গিয়েছেন, এমনটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না বলেই তদন্তকারীরা মনে করছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়লে শুধু মাথায় চোট লাগল কী ভাবে? তদন্তকারী অফিসারদের একাংশ বলছেন, গড়িয়ে পড়লে মুখের সামনের দিকে চোট লাগা স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে তা নেই। বরং মাধবের পাঁজর ও গলার শিরায় চোট রয়েছে। মারধর না-করলে এই চোটগুলি কী ভাবে লাগল, তদন্তকারী অফিসারেরা তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন।
মাধবের দেহ যে-ভাবে সিঁড়ি থেকে তুলে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। সিসিটিভি-র ফুটেজে ধরা পড়েছে, মাধব গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার পরে পানশালার কর্মী ও রক্ষীরা তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, যে-ভাবে মাধবকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা অমানবিক। গোলমালই যদি না-হবে, আহত মাধবকে ও-ভাবে নিয়ে যাওয়া হল কেন?
এই দিকটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তদন্তকারীরা জানান।
মাধবের পরিবারের লোকেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, ওই যুবক পানশালার সামনে ৩সি/১ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা দু’টি বাসের মাঝখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। তাঁদের প্রশ্ন, আহত মাধব কী ভাবে ওখানে গেলেন? পানশালার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বক্তব্য, পানশালার বাউন্সারেরাই মাধবকে উল্টো দিকের রাস্তায় নিয়ে যান। তার পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি খুঁজতে থাকেন। প্রশ্ন উঠেছে, তা-ই যদি হবে, মাধব দু’টি বাসের মাঝখানে গেলেন কী ভাবে? জবাব দিতে পারেননি পানশালা-কর্তৃপক্ষ। মাধবের স্ত্রী কণিকা দাস বলছেন, “ওরা আমার স্বামীকে রাস্তার ধারে দু’টি বাসের মাঝখানে দীর্ঘ ক্ষণ ফেলে রেখেছিল। ও যদি ওই পানশালাতেই পড়ে গিয়ে থাকে, তা হলে ওরা সরাসরি ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল না কেন?”
পুলিশ কি এ-সব দিকও খতিয়ে দেখছে? ব্যারাকপুরের পুলিশকর্তারা সরাসরি উত্তর দেননি। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে কী মিলেছে, তা-ও জানাতে চায়নি পুলিশ। ব্যারাকপুর কমিনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান দেবাশিস বেজ বলেন, “ওই পানশালার কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মাধবের পরিবারকেও। তার পরেই আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব।” পুলিশ জানায়, ওই কমিশনারেট এলাকার অন্তর্গত সব পানশালার বাউন্সার ও রক্ষীদের নামধাম, পরিচয়পত্রের সবিস্তার খতিয়ান চাওয়া হয়েছে।
পুলিশ পানশালার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিতে চাইছে না বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ। শনিবারেই এলাকার লোকজন অভিযোগ করেন, ওই পানশালায় নাচগান নিয়ে প্রায়ই গোলমাল হয়। কটূক্তি সহ্য করতে হয় পথচলতি মহিলাদেরও। দীর্ঘদিন ধরে এটা চললেও পুলিশ নিষ্ক্রিয়। তবে দমদম থানার দাবি, ওই পানশালায় যে নাচগানও হয়, এত দিন সেটা নাকি তাদের জানাই ছিল না!
বাসিন্দারা জানান, মাধবই ছিলেন দাস পরিবারের একমাত্র সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি অথৈ জলে পড়ে গেল। এ দিন লেক টাউনের নস্করপাড়ায় মাধবের এক কামরার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, সাত বছরের ছেলে আকাশ এবং তিন বছরের মেয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে বসে আছেন মাধবের স্ত্রী। সকলেই প্রায় নির্বাক। ভিড় করে রয়েছেন আত্মীয়স্বজন। |