রোববার রোববার আমরা কয়েক জন এক সঙ্গে গানবাজনা করি, শিখি। প্রত্যেক দিনই শুরু হয় কোনও-না-কোনও রাগ দিয়ে। এই সে দিন ধরলাম আমরা ভীমপলশ্রী রাগটিকে। কোন কোন বাংলা গান মোটের ওপর এই রাগে বাঁধা, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। কাজী নজরুল ইসলামের ‘পাষাণে ভাঙালে ঘুম’-এর কথা মনে এল। সব গান যে ১০০% খাঁটি ভীমপলশ্রী হতেই হবে, তা কেন। মেজাজটা পাওয়া গেলেই হয়। বিকেলের এই রাগটিতে এক ধরনের বিষণ্ণতা টের পাই। অন্যরাও কি পান?
জগদ্বিখ্যাত উডস্টক ফেস্টিভালে আচার্য রবিশঙ্কর নাকি ভীমপলশ্রী বাজিয়েছিলেন। হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর মনে বিষণ্ণতা জাগিয়ে তোলার জন্য? না কি শুদ্ধ রেখাব, কোমল গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, শুদ্ধ ধৈবত আর কোমল নিখাদ— এই পরদাগুলির সাহায্যে পাশ্চাত্যের ‘মাইনর’ স্কেলের মেজাজটা আনতে, যাতে ভারতীয় রাগসংগীত সাহেব-শ্রোতাদের কানে কম অচেনা লাগে? তাও যদি হয়, ‘মাইনর’ স্কেল যে মানুষের মনে একটু হলেও বিষাদ জাগাতে পারে, তা সাহেবরাই কিন্তু বলে থাকেন।
সংগীতে সব সময়ে ব্যঞ্জনাগত কোনও নির্দিষ্টতা থাকে না বলেই হয়তো ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এর জার্মান সংস্করণটি ‘মাইনর’ স্কেলে। সেই সঙ্গে আবার কোমল ধৈবত। মানুষের অধিকার লড়াই করে আদায় করার গান মাথা উঁচু করে খোলা গলায় হইহই করে গাইতে গিয়ে কেন আবার কোমল ধৈবতের ওই বাড়তি বিষণ্ণতা! সব ক’টা পরদা শুদ্ধ হলে রোদ-ঝলমলে হত না? তা হলে ‘পঞ্চভূতের মূলেতে যে ঠেলাটা লাগছে’, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ‘মাইনর’ স্কেল ও ফাউ হিসেবে কোমব ধৈবত বিষাদ জাগাবেই জাগাবে এমন কোনও স্থিরতা নেই।
কিন্তু আমাদের দেশের ভীমপলশ্রীর বেলা? এই রাগে বাঙালির সর্বকালের সুপারহিট হওয়ার কথা পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া
‘আমার সাধ না মিটিল
আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা।’
নাকি বুড়ো হয়ে গিয়েছি বলে এটা মনে হচ্ছে। এই তো সে দিন, রজত নামে এক কিশোর আমাদের পাড়ার ব্যাংকে আমায় দেখতে পেয়ে লাজুক-লাজুক হেসে বললেন, ‘আপনি কবীর সুমন? ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ সিনেমায় আপনাকে দেখেছি, গান শুনেছি।’ জানালেন, ওই ছবির গানগুলো তাঁর ভাল লেগেছে, যদিও বাংলা রক্ তাঁর পছন্দ নয়, কারণ বড্ড জোরে আওয়াজ হয়।
|
এই কিশোর রবীন্দ্রসংগীত শোনেন কি? প্রথমেই বললেন ‘জাগরণে যায় বিভাবরী।’ ‘পঞ্চভূতের মূলেতে’ এ বারে ওই ছায়াছবিটিরই ‘ঠ্যালা’। ‘আমার সাধ না মিটিল’ গানটি কি এই কিশোর শুনেছেন কখনও? সকাল সাড়ে দশটায় এই প্রাণবন্ত কিশোরের মনমেজাজ চটকে দেওয়ার সাধ আমার ছিল না, তাই জানতে চাইনি।
তাঁর বয়সে আমি কিন্তু শুনেছিলাম। হোমওয়ার্ক না করে, অঙ্কে নিয়মিত ফেল করে সারা ক্ষণ রেডিয়োয় শোনা গান গাইতাম বলে তুলেও নিয়েছিলাম গানটি। আজও পুরোটাই মনে আছে। আমার বয়সি আরও অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। একেবারে খাস ভীমপলশ্রী। গানটির বেচারি-বেচারি কথা ‘পৃথিবীর কেউ ভাল তো বাসে না
এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না’
বা ‘অনেক কেঁদেছি কাঁদিতে পারি না
বুক ফেটে ভেঙে যায় মা’
কি এই রাগে আরও খুলেছে? বেলাশেষের এই রাগে?
বেলাশেষ। ভীমপলশ্রীর রং, মেজাজ। হঠাত্ মনে পড়ে গিয়েছিল সুধীরলাল চক্রবর্তীর একটি সুর: ‘যেদিন রব না আমি।’ পরদায় পরদায় হুবহু মিল নেই। মিল রয়েছে মেজাজে। আমাদেরই এক জন সহ-শিক্ষার্থী, মিঠু, দেখছি গানটি ইন্টারনেট থেকে উদ্ধার করে পোস্ট করে দিয়েছেন। জয় ইন্টারনেট। জয় সমকাল। ইন্টারনেট, ইউটিউব আছে বলে তবু অনেক পুরনো গানবাজনা আমরা এখনও শুনতে পারি, পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি শোনার অভিজ্ঞতাটা।
আশ্চর্য, এই গানটি আমি কখনও রেডিয়োয় শোনার সুযোগ পাইনি। এ-গান আমি শুনেছিলাম আমার কৈশোরে, যৌবনে সুধীরলালের স্মৃতিবাসরে— তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিখিল চন্দ্র সেনের আয়োজন করা সুধীরলাল সুরারোপিত গানের বাত্সরিক অনুষ্ঠানে। আমার বাবার প্রাণের বন্ধু নিখিল চন্দ্র সেনের কথা এই ‘সুমনামি’তেই আমি অনেক আগে লিখেছিলাম। তাও অবশ্যই আবার উল্লেখ করা যায় তাঁর নাম, তাঁর অবদানের কথা। বার বার বলা যায়, কারণ বাংলার এই অসামান্য সুরকার ও শিক্ষকের কথা বলা হয়েছে বা আলোচনা করা হয়েছে খুব কমই।
প্রতি বছর নিখিল চন্দ্র সেন নিজের খরচে তাঁর অকালপ্রয়াত জিনিয়াস বন্ধু সুধীরলাল চক্রবর্তীর স্মৃতিতে একটি অনুষ্ঠান করতেন, সেখানে বাংলার সেরা শিল্পীরা, বিশেষ করে সুধীরলালের ছাত্রছাত্রীরা এই ক্ষণজন্মা সুরকারের সুরগুলি শোনাতেন। বছরের ওই একটি দিন এক স্বর্গীয় বন্ধুতার সুবাদে আমরা চোখের সামনে দেখতে পেতাম ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উত্পলা সেন, নীতা সেন, দেবু দত্ত, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে, একটি তবলার সংগতে আধুনিক বাংলা গান শোনাচ্ছেন— সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে।
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রায় প্রত্যেক সুধীরলাল স্মরণ অনুষ্ঠানে ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায়’ গানটি শোনাতেন। এক বার, মনে আছে, গীতিকার পবিত্র মিত্র শ্রোতাদের আসনে ছিলেন। গানটি ধরার আগে ধনঞ্জয়বাবু পবিত্র মিত্র মহাশয়কে সসম্মানে ডেকে নিলেন। পবিত্রবাবু মঞ্চে উঠে গিয়ে গায়কের একটু পেছনে একটি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসলেন।
ওই গানের একেবারে গোড়ায় ও শেষে ‘খেলাঘর...মোর খেলাঘর’ এই কথাগুলি ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইতেন তাল-ছাড়া। সুধীরলাল চক্রবর্তীর গ্রামোফোন রেকর্ডেও এ রকমই ছিল। ‘মোর’ কথাটি ধনঞ্জয়বাবু মধ্য থেকে তারসপ্তকে নিয়ে যেতেন কী সাবলীল ভাবে, কোনও কালোয়াতি না দেখিয়ে, আধুনিক ভঙ্গিতে, নিখুঁত সুরে। গলার দাপটের সঙ্গে স্বরমাধুর্য কী ভাবে প্রকাশ পেতে পারে, তা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গান না শুনলে পুরোপুরি জানা যাবে না। পুরুষের গলায় পৌরুষের সঙ্গে কোনওরকম দেখনদারি ও নাটকীয়তা ছাড়া অনুচ্চ ভাবে যে সূক্ষ্ম অভিমান ও ব্যথা মিশে থাকতে পারে, তার পরিচয় আধুনিক বাংলা গানে আমরা প্রথম এবং সম্ভবত শেষ পেয়েছি ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গায়কিতে। আর এক বিরাট কণ্ঠশিল্পী মান্না দে কিন্তু বেদনার ইঙ্গিত দিতে গিয়ে অল্পবিস্তর নাটকীয়তা, ভাবাবেগ এনে ফেলতেন, বিশেষ করে ষাটের দশক থেকে।
শুধু অভিমান নয়, মনের স্ফূর্তি ও আনন্দের দিকটিও ধনঞ্জয়বাবুর গায়কিতে ধরা দিত কোনও রকম বাড়াবাড়ি ছাড়া। তাঁর গাওয়া ‘বলেছিল কী যেন নাম তার’, ‘ওগো সুচরিতা’, ‘ঝিরঝিরঝির ঝিরঝিরি বরষা’ এই সব গান মনোযোগ দিয়ে শুনে দেখলেই বোঝা যাবে। উচ্চারণের কিঞ্চিত্ সাবেকিয়ানা সত্ত্বেও গায়কির এ হেন স্মার্টনেস ও নির্বিকল্প আধুনিকতা বাংলা গানের ইতিহাসে বিরল।
সুধীরলালের গলা ছিল চিকন। তারসপ্তকে স্বভাবক্ষিপ্র হরিণের মতো বিচরণ করতে পারতেন তিনি নিটোল ধ্বনিমাধুর্য নিয়ে। তাঁর গায়কির এই গুণটি আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর ছাত্র শ্যামল মিত্র। তাঁর গুরুর মতো তাঁর কণ্ঠও ছিল চিকন ও তারসপ্তক-ঘেঁষা। যত চড়া তত মিষ্ট। কণ্ঠে গাম্ভীর্য না থাকলেও সুধীরলাল চক্রবর্তী তাঁর গায়কি দিয়ে, স্বরপ্রক্ষেপের ধরন দিয়ে ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ‘যেদিন রব না আমি’ আর ‘তব কাঁকনের ছন্দে আমার ব্যাকুল বাঁশরি বাজে’ এই দুটি গান সুধীরলাল স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতি বছরই শোনা যেত সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। সুধীরলালের সুরবৈশিষ্ট্য নিয়ে আগামী পর্বেও আমায় লিখতে হবে, নয়তো করা হবে অবিচার। |