|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: মহেশ-এর
|
ঋষিগোপাল মণ্ডল |
গ্রাম ছোট, গ্রামের লোকজনের চাহিদাও ছোট ছোট। বাংলাদেশ-কোচবিহারের সীমান্ত লাগোয়া এই গ্রামে গরু পাচারকারীদের দাপটে লোকজন টুঁ শব্দটি করতে পারে না। গ্রামের সীমানায় পথের ধারে গফুর জোলার বাড়ি। বাড়ির উঠোন থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমানার কাঁটাতার, বিএসএফ জওয়ানদের আনাগোনা স্পষ্ট দেখা যায়। গফুরের বাড়িটা গফুরের মতোই কঙ্কালসার। বাড়ির সামনে যে মাটির পাঁচিল ছিল, তা গত বর্ষায় ধসে যাওয়ায় গফুরের টুটাফুটা সংসার এসে আক্ষরিক অর্থেই পথে মিশেছে।
পথের ধারে পিটালি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ভোলা নস্কর উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল, ও গফরা চাচা, ঘরে আছ নাকি? গফুরের বছর পনেরোর মেয়ে আমিনা দুয়ারে দাঁড়িয়ে সাড়া দিল, বাবার জ্বর। ভোলা নস্কর আমিনাকে আপাদমস্তক চোখ দিয়ে চাটল। মনে মনে বিড়বিড় করল, ফিগার তো ভালই বানিয়েছ মামণি। পিচিক করে গুটখাথুতু ফেলে বলল জ্বর! চল তো ঘরে গিয়ে দেখি। তেমন হলে হাসপাতালে অ্যাডমিট করতে হবে। চারপাশটা চট করে এক বার চোখ বুলিয়ে পঞ্চদশী আমিনার পিঠে হাত রেখে ঘরে ঢুকল। আমিনার মনে হল চ্যাটচেটে একটা হাত খুব অস্থির ভাবে তার পিঠে কী যেন খুঁজছে। সে সরে গেল। ভোলা ঘরে ঢুকে দেখল একটা পুরনো চৌকির উপর গফুর শুয়ে আছে। শরীরের তলায় একটা খেজুর পাতার একটা পাটি, উপরে পাতলা চাদর। ভোলাকে দেখে বিরক্ত গফুর তেতো মুখে ওঠার চেষ্টা করল। পারল না। ভোলা ফের আমিনার দিকে তাকাল। অভাবের সংসারেও যৌবন যথাসময়ে আসে। গলায় ছদ্ম আশঙ্কা এনে বলল, তোর বাবার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে রে! ওষুধ দিয়েছিস?
এর আগেও বারকয়েক খেজুরে আলাপ করার চেষ্টা করেছে এই লোকটা। এ বছর ইদের আগে একটা গরু আর দুটো মোষের জন্য টাকার বায়নাদার নিয়ে এসেছিল। বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে হাঁক পেড়ে কথা বললেও এর আগে কখনও ঘরে ঢোকেনি। গফুর শুনেছে, বাংলাদেশে মেয়ে আর গরু পাচার করে সে দু’হাতে টাকা কামাচ্ছে। এক বার পুলিশ ওকে জাল নোট কারবারি সন্দেহে ধরলেও দু’দিনও আটকে রাখতে পারেনি। বিএসএফ, বিডিআর, পার্টির লোকজনের সঙ্গে নাকি এই লোকটার দারুণ আশনাই। এ বারে একেবারে ঘরে এসে এত দয়ামায়া দেখানোর হেতুটা না বুঝতে পেরে গফুর শুধু চেয়ে রইল।
ভোলা খুব মোলায়েম করে বলল, সকালে যাওয়ার সময় দেখে গেছি বাঁধা, ফেরার পথে দেখছি তেমনই ঠায় বাঁধা। গরু-মোষগুলোকে খেতেটেতে দেওয়া হয়েছে? সামনে কয়েক আঁটি বিচুলি ফেলে দিলেও তো চিবোতে পারে। তোমার মেয়ে ভাত রাঁধেনি? ফ্যানে-জলে দে না এক গামলা। খাক। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী। |
ভোলা বিদেয় হবার পর আমিনা তার বাবাকে মাথা ধুইয়ে দিল। দাওয়ার বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসিয়ে পিতলের থালায় বাবার জন্য শাক-ভাত সাজিয়ে দিয়ে একটা এনামেলের সানকিতে নিজের সামান্য ভাত নিয়ে বসল। গফুর ক্লান্ত স্বরে বলল, ফ্যানটুকু দে তো মা, মহেশকে খাইয়ে দিয়ে আসি। আমিনা জানে তার বাবা মহেশ অন্ত প্রাণ। মহেশ আর গফুর দুজনের শরীরই দিন দিন যেন পাল্লা দিয়ে হাড়সর্বস্ব হয়ে উঠছে। চোখের জল হাতের তালুতে মুছে আমিনা বলল, ফ্যান আজ নেই বাবা, হাঁড়িতেই মরে গেছে। গফুর কত কী যেন চিন্তা করে হঠাত্ এই সমস্যার মীমাংসা করে বলল, জ্বর গায়ে ভাত খাওয়া কি ভাল মা? এক কাজ কর, ভাতটা মহেশকে ধরে দিয়ে আয়।
পাঁচ-সাত দিন পরে এক দিন গফুর চিন্তিত মুখে দাওয়ায় বসেছিল। জ্বরের ঘোর এখনও কাটেনি। বার কয়েক ডাকার পর আমিনারও সাড়া মেলেনি। দাওয়া থেকে উঁকি মেরে বাবলাতলায় মহেশ আর মোষগুলোকে দেখতে পেল। ওদের ডাবার সামনে নতুন তাজা খড়! কোথা থেকে এল এ সব? যত দূর সম্ভব গলা চড়িয়ে আমিনাকে ডাকল গফুর। সাড়া নেই। গেল কোথায় মেয়েটা? পড়ন্ত বেলায় আমিনা হাসিমুখে ফিরে এসে বলল, ভোলাচাচার চালকলে গেছিলাম। ঘরে তো ক’দিন ধরেই খুদকঁুড়োও নেই। চাল-ডাল-তেল-আনাজপাতি সব পাঠিয়ে দিয়েছে চাচা। কাল চার বোঝা বিচালিও পাঠিয়েছিল মহেশ আর মোষদুটোর জন্য। বলছিল, বক্সিরহাট বাজারে কী একটা কোম্পানিতে আমাকে কাজে ঢুকিয়ে দেবে। বাবা দেখো, এ বার আমাদের আর কোনও অভাব থাকবে না। তোমার ওষুধ কিনতে কিছু নগদ টাকাও দিয়েছে। এই দেখো...বেশ কয়েকটা নোট দেখাল আমিনা। আমিনার গায়ে নতুন জামা! দু’বছর হল ইদে সে আমিনাকে নতুন জামা কিনে দিতে পারেনি। এর মধ্যেই ভোলা নস্করের দেওয়া জামা পরে বসে আছে? রাগে-বিস্ময়ে গফুরের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। অকস্মাত্ সোজা উঠে দাঁড়িয়ে উদ্ধত কণ্ঠে বলল, খবরদার বলচি, এই পাপের টাকা, জিনিসপত্র আমার ঘরে ঢোকাবি না। ভাল হবে না। আমিনা ঘর থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে নিরুত্তরে দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
তার পর কী ঘটল, বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। তবুও উল্লেখ থাক, গফুর যখন রোগশয্যায় কাতর, দু’দিন সন্ধ্যায় ভোলা নস্কর আর তার এক শাগরেদ গফুরের দাওয়ায় এসে বসেছিল। তারা আমিনাকে ভাল কোম্পানিতে কাজের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে। তাদের ঘরে কী সব সরকারি প্রকল্পে কারেন্ট এনে দেবার এবং তা ছাড়াও গান শোনা যায়, ছবি তোলা যায় এমন মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে। প্রায় জোর করে আমিনার হাতে নগদ টাকা গুঁজে দিয়ে গেছে। প্রথম দিন গফুর খাবার প্রত্যাখ্যান করলেও, তার রোগক্লিষ্ট শরীর শেষ পর্যন্ত আর গরম ভাতের লোভ এড়াতে পারেনি। দ্বিতীয় দিন সে গোগ্রাসে ভাত খেয়েছে। তৃতীয় দিন গভীর রাতে প্রবল চেঁচামেচিতে গফুরের ঘুম ভেঙে গেল। কোনও মতে উঠে রাস্তায় এসে বুঝল, ফের গরু-পাচারকারীরা এ গ্রামে হানা দিয়েছে। তার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। ছুটে বাবলাতলায় এসে দেখল, মহেশ নেই! মোষদুটোও নেই। মাটিতে বসে পড়ল সে। কারা যেন বলাবলি করছে, গ্রামের কয়েকটা বাড়িতে ওরা মেয়ে-বউদের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ধর্ষণ করেছে। কয়েকজন সোমত্ত মেয়ে-বউকে সীমান্তের ও-পারে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। শুনে গফুরের মাথায় যেন বাজ পড়ল। আমিনার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘরের দিকে ছুটল সে। আমিনা ঘরে নেই। পড়শিদের সঙ্গে মিলে আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কোথাও নেই।
অন্ধকার গভীর নিশীথে সে মেয়ের খোঁজে বের হল। এই গ্রামে তার আত্মীয় কেউ ছিল না। আঙিনা পার হয়ে পথের ধারে বাবলাতলায় এসে গফুর থমকে দাঁড়িয়ে হঠাত্ হুহু করে কেঁদে উঠল। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলে বলল আল্লা! |
|
|
|
|
|