প্রবন্ধ ১...
কোলাহলের আড়ালে
বাংলা থিয়েটারের বর্তমান অবস্থা বেশ জটিল। এই সময়টা নানা কারণেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং ‘নানা সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ’। উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রাখা অংশটি উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক থেকে। কাপ্তেনবাবু কথাটা বলেছিলেন প্রিয়নাথ মল্লিকের একটা নাটক সম্বন্ধে, কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ করে। আমি সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে যে ‘নানা সম্ভাবনা’র অনুষঙ্গ টানলাম, তার মধ্যে অবশ্য ব্যঙ্গরসের থেকে বিস্ময়ের ভাব বেশি।
একটা প্রশ্নের সামনে বার বার পড়তে হয় ইদানীং। এত নাটক হচ্ছে, এত দল, হল-এ ডেট পাওয়া নিয়ে হাহাকার পড়ে গেছে, দর্শকের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা, সরকারি অনুদানের সূত্রে এবং স্পন্সরশিপের বাহুল্যে, চলচ্চিত্রের মতো বড় বড় হোর্ডিংয়ে নাটকের বিজ্ঞাপন দেখেশুনে সব কিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে বাংলা নাটক একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সামনে এসে পড়েছে, যা প্রায় যেন আবার একটা স্বর্ণযুগের সূচনা করছে এবং ‘নানা সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ’। কিন্তু আমার কিছু সংশয় আছে, বিভ্রান্তি আছে।
যে উপসর্গগুলো দেখে বাংলা নাটকের এক সামগ্রিক সমৃদ্ধির মূল্যায়ন করা হচ্ছে, সেগুলো কি শিল্পগুণের নির্ণায়ক হতে পারে? অনেকসংখ্যক দল কী প্রযোজনা করছে, কী তাদের নাটকের মান, কী অভিনয়ের মান ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো খুবই জরুরি। অনেকসংখ্যক সাবান, গাড়ি বা মোবাইল বিক্রি হলে শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুবই উৎসাহের। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কি সংখ্যার ব্যাপ্তিকেই মূল্যায়নের মাপকাঠি করা যাবে? বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ বলে যে সময়টাকে চিহ্নিত করা হয়, খুব গভীরে না গিয়েও একটু উপর থেকে নজর করলেই দেখা যাবে যে, সেই সময় নানা নাটক হচ্ছে, পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, নাটকের মানের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ মাত্রা আছে, যে-সব পরিচালক, অভিনেতা কাজ করছেন তাঁদের অনুশীলন, চর্চা, অভিজ্ঞান ও মেধার একটা স্বাক্ষর অনায়াসে চেনা যাচ্ছে। বড় দল ভেঙেছে বটে, কিন্তু দল ভাঙার পর নতুন দলগুলো আবার বড় মাপের কাজ করেছে। উৎপলবাবুর শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা নতুন পি এল টি-তে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ কাজ নান্দীকার ভাঙার পরে। বিভাস চক্রবর্তী থিয়েটার ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে আসার পর জীবনের অন্যতম কাজ করেছেন। সেই সময়ে খারাপ কাজ কি হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দেখলে, অনেকগুলো দল বা নির্দেশক সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শন থেকে, ভিন্ন নাটকীয় স্টাইলে উন্নতমানের নাট্যচর্চা বা অনুশীলন করে চলেছেন। আমরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, নাট্যলিখনে, নাট্যভাষে, প্রযোজনা ও অভিনয়ের মানে আমরা ‘টিনের তলোয়ার’, ‘জগন্নাথ’, ‘চাক ভাঙা মধু’, ‘তখন বিকেল’, ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ বা জুলিয়াস সিজারের ‘শেষ সাত দিন’ এবং ভোমা ইত্যাদির প্রযোজনাকে অতিক্রম করতে পেরেছি?
আমি কোনও স্মৃতিবিহ্বলতায় মজে নেই। শুধু কিছু প্রশ্ন তুলছি। সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার সম্বন্ধে যেটুকু ওয়াকিবহাল, যে সাম্প্রতিক কাজ দেখেছি, তাতে এই প্রশ্ন তোলা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তবে গত পনেরো বছরে, আমরা সমসাময়িকরা যখন থেকে নিয়মিত কাজ করছি, সেই সময়ে কিছু ভাল কাজ হয়েছে, জনপ্রিয়ও হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর দলের সংখ্যা অনেক বাড়লেও, নাটকের উন্নতিসাধনে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও, নাটকে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রবেশ ঘটলেও থিয়েটারের মান মধ্যমানেরও নীচে অপসৃত। কারণ, আমাদের থিয়েটার যাপনে, অনুশীলনে, চর্চায় আমরা ঠিক জায়গাগুলোতে জোর দিচ্ছি না। আসলে থিয়েটার আদতে কোথায় থিয়েটার হয়ে ওঠে, কোথায় শিল্পমাধ্যম হিসেবে তার অভিনবত্ব, তার পরীক্ষানিরীক্ষা করা এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে নতুন ভাবনা, এই সব ক্ষেত্রে জোর না দিলে সাম্প্রতিকের থিয়েটার নিয়ে আমাদের খুব বেশি কিছু গর্ব করার থাকবে না।
নাট্যভাষের কথা বললেই একটা ভুল বোঝার অবকাশ তৈরি হয় যে, নাটককে আমি একটা নির্দেশকের মাধ্যম হিসেবে দেখছি। নাট্যভাষ বা থিয়েটারের ভাষা মানে শুধু নির্দেশকের এক্তিয়ার নয়, এ এক সমগ্র প্রক্রিয়া। নাট্যকার থেকে শুরু করে ড্রামাটুর্গ, সিনোগ্রাফার, আলোকশিল্পী, সংগীতকার, অভিনেতা ও নির্দেশক মিলে এই নাট্যভাষের ফুল ফোটান। আমাদের উচিত সেই প্রযোজনাগুলোকে চিহ্নিত করা, যেগুলো মঞ্চে অন্তত চেষ্টা করছে নাট্যকলার একটা বিস্তার ঘটাতে, যেখানে একটা নিরীক্ষার প্রয়াস আছে। মিডিয়ার প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা এই কাজগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করি না। মানুষ বা সাধারণ নাট্যানুরাগী দর্শক তো অনেকটাই নির্ভর করেন মিডিয়ার ওপর, তাদের মতামতের ওপর। কিন্তু মিডিয়া যে সব সময় ঠিক মতামত দিচ্ছে, সেটা একদমই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। মিডিয়া এখন সাফল্য, ক্ষমতা, সেলিব্রিটি স্টেটাস-এর ওপর বেশি প্রাধান্য দেয়। তাদেরও নিশ্চয়ই নানা চাপ থাকে। তাই আমার মনে হয়, আমরা যারা থিয়েটারের অন্দরমহলের লোক, তাদের অন্তত কর্তব্য সেই নাটকগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যেগুলো সেই ভাবে মিডিয়া আনুকূল্য পাচ্ছে না বা বর্তমানে শিল্পী-মহলে রাজনৈতিক বিভেদের কারণে নানা অসুবিধায় পড়ছে।
আমার দেখা সাম্প্রতিক প্রযোজনাগুলোর মধ্যে কৌশিকের ‘থানা থেকে আসছি’ এবং অবন্তীর ‘তিন কন্যা’ (ছবিতে এই নাটকের একটি মুহূর্ত) নাটক দুটি দেখে আমি একটু স্বস্তি পেয়েছি। কৌশিক সিনিয়র পরিচালক আর অবন্তী সেই অর্থে নবীনা। দুটো নাটকই নাটক হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে বরেণ্য। কৌশিক সব সময় চেষ্টা করে ওর নাটকে একটি সমকালীন প্রেক্ষিত আনতে। সেটা মাঝে মাঝে একটু বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর নাটক দেখলে একটা নাটকীয় অভিজ্ঞতা হয়। ও চেষ্টা করে থিয়েটারকে যতটা সম্ভব সচল করতে নানা প্রকৌশল এবং নাটকীয় মুদ্রার ব্যবহারে। সেটাই খুব জরুরি। ওর ম্যাকবেথ-এর মঞ্চায়ন দেখে উদ্বেলিত হয়েছি। তিন কন্যা নাটকটি একদমই সহজ নাটক নয়। অবন্তী মুনশিয়ানার সঙ্গে প্রযোজনাটি খুব সহজ ভঙ্গিতে বিন্যাস করেছে। মঞ্চের ‘মিনিম্যালিস্ট’ ব্যবহার, দৃশ্যমুদ্রার সাবলীল প্রয়োগ এবং কিছু নির্দিষ্ট মঞ্চচিহ্ন দেখে প্রযোজনাটিকে এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ বলে মনে হয়েছে। কয়েকটি চরিত্রের অভিনয় দেখে ভরসা জাগে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, অন্তত থিয়েটারের নামে মঞ্চে কিছু সংলাপ বলে যাওয়ার মতন স্থবির নয়। একটা থিয়েটারকে কেন থিয়েটার বলব, তার একটা কারণ তো থাকতে হবে। চেকভের নাটকের যে বিস্তীর্ণ চালচিত্র, যে গভীর বোধ, যে সূক্ষ্ম আবেগ, তা মঞ্চের ভাষায় পাঠ করা দুরূহ কাজ। অবন্তী তা করেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে নাটক নিয়ে নানা নতুন পরিকল্পনার কথা শুনছি এবং পড়ছি। সফল হোক সেই সব নতুন ভাবনা, ছড়িয়ে পড়ুক থিয়েটার। কিন্তু থিয়েটার কলার মূল যে জায়গা, সেটা যেন অবহেলিত না থাকে। রাজনৈতিক মতভেদ থাকুক, বিতর্ক হোক— মঞ্চের ভাষায় এবং শিল্পীর ভঙ্গিতে সেই সব বিতর্ক, দার্শনিক মতানৈক্য উঠে আসুক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.