সান্তা ক্লজ-কে লইয়া ঝঞ্ঝাটের ঋতু পুনরায় আগত। মার্কিন এক শিক্ষক এই সপ্তাহেই এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রকে বলিয়াছেন, সান্তা শ্বেতাঙ্গ। তাই শুনিয়া ছাত্রটি এমন ভাঙিয়া পড়িয়াছে ও তাহার পিতা এমন রাগিয়া লাল হইয়াছেন, টেলিভিশনেও এই ‘অত্যাচার’-এর কাহিনি বিবৃত হইয়াছে এবং শিক্ষককে ছুটি নিতে বাধ্য করা হইয়াছে। ইংল্যান্ডের এক বিদ্যালয়ে আবার এক শিক্ষক স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছেন, বাস্তবে সান্তার অস্তিত্বই নাই। আর একটি স্কুলে বলা হইয়াছে, শিশুরা প্রতি বৎসর সান্তাকে যে পত্রগুলি লিখিয়া থাকে, তাহার উত্তর সান্তা দেন না, ডাকঘরের সাধারণ কর্মীরাই উত্তর দিয়া দেন। উভয় ক্ষেত্রেই প্রকাণ্ড হুলস্থুল বাধিয়াছে। শিশুরা হাপুস নয়নে কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ি গিয়াছে, অভিভাবকগণ ‘এমন সত্যভাষণের প্রয়োজন কী’ বলিয়া স্কুলে চড়াও হইয়াছেন এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন, শিশুদের জীবন হইতে জাদু কাড়িয়া লওয়া আদপেই উচিত হয় নাই। সত্যই, তাহারা সমগ্র বৎসর ধরিয়া এই উৎসবের পানে তাকাইয়া থাকে, দুষ্টামি করিলে সান্তা ভাল উপহার দিবেন না জানিয়া অনেকে বহু বদমেয়াশি হইতে প্রাণপণ সংযমে নিবৃত্ত থাকে, ক্রিসমাসের প্রভাতে উঠিয়া দুরুদুরু বক্ষে ঝুলন্ত মোজা খুলিয়া হুমড়ি খাইয়া পড়ে সান্তা-আনীত উপহার দেখিবে বলিয়া। এই সকল অকলুষ আনন্দের উৎসে কুঠারাঘাত করিবার প্রখর উপযোগিতা নাই বলিয়াই মনে হয়। যদি শিশুর জীবনে অলীক বিশ্বাসই না থাকিল, উদ্ভট কল্পনাই না পক্ষ বিস্তার করিল, রাত্রে কলঘরে যাইতে সে স্কন্ধকাটা ও ড্রাগনের পদশব্দই না শুনিতে পাইল, তবে সেই ইন্দ্রজালহীন জীবনের সহিত প্রাপ্তবয়সির রামগরুড়প্রতিম দিনযাপনের পার্থক্য কী?
তর্ক উঠিতে পারে, শিশুকে কিছু অবাস্তব হিজিবিজি শিখাইয়া তাহার মনোরঞ্জন করিতে হইবে, এই প্রথা মানিব কেন। কেনই বা সত্যকে, বাস্তবকেই সুন্দর ও শোভন করিয়া তাহাদের সম্মুখে সাজাইয়া দিব না। সমস্যা হইল, বাস্তব আর সত্য সর্বদা সমার্থক নহে। একটি মানুষের বেদনার সত্য বাহির করিয়া আনিতে শিল্পীকে মনুষ্য-মুখাবয়ব অবাস্তব রকম বিকৃত করিয়া আঁকিবার প্রয়োজন পড়িতে পারে। আবার, চুম্বনকালীন তুরীয় সুখ বুঝাইতে নরনারীকে উড়ন্ত হিসাবে আঁকিবার সার্থকতা গোচর হইতে পারে। শৈশবে একটি মানুষ সদ্য গড়িয়া উঠিতেছে, সে তখন কল্পনার ক্রীতদাস, মাধ্যাকর্ষণের ভৃত্য নহে। এই সময়ে তাহার চিন্তাভাবনাগুলিকে কেবল ‘সম্ভব’-এর সীমানায় বাঁধিয়া রাখিলে, ‘যাহা ঘটে’ ও ‘যাহা ঘটা উচিত’ দিয়া তাহার ডানা দুটি কাটিতে লাগিলে, কেবল তাহার সুখে অগ্নিসংযোগই হইবে না, তাহার মস্তিষ্কে ‘অসীমতা’র বীজকে সমূলে ধ্বংস করা হইবে। রূপকথা যে বাস্তবে ঘটে না, তাহা শিশু কৈশোরে উপনীত হইয়াই বুঝিতে পারে, কিন্তু রূপকথার মায়াঞ্জন যাহার চক্ষুকে সকল বয়সে রঞ্জিত রাখে, সে হুঁকোমুখো হ্যাংলার আশ্চর্য অবয়ব গড়িতে পারে ও আনন্দে স্নান করিতে পারে। এই জন্য পিকাসো বলিয়াছিলেন, ‘প্রতিটি শিশুই শিল্পী। সমস্যা হইল, বড় হইয়াও শিশু থাকিতে পারা যায় কী ভাবে।’ কেবল শিল্প নহে, যে কোনও ক্ষেত্রে একটি মানুষকে অসাধারণ হইয়া উঠিতে গেলে, সকল ‘হয়’, ‘হইয়া আসিতেছে’র বাহিরে গিয়া, ‘সম্ভব’কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া, ‘এমন কেন সত্য হইবে না আহা’ মর্মে ভাবনাকে চালিত করিতে হয়। মানুষ যেমন করিয়া গান শুনিতে অভ্যস্ত, তাহা সম্পূর্ণ বদলাইয়া, গান-যন্ত্রটিকে অসম্ভব রকম ক্ষুদ্র করিয়া তাহার তালুবন্দি করা যায় কি না, এই ‘অবাস্তব’ চিন্তার ধারাই স্টিভ জোব্সকে নায়ক করিয়াছিল। গাড়ি-ব্যবসায়ীকেও ভাবিতে হয়, ‘গাড়ি যদি নিজেই পথ বলিয়া দিত!’ তবে জিপিএস সৃষ্ট হয়। ‘আমি আলোকের গতিতে ভ্রমণ করিলে কী হইবে’ এমত উদ্ভট চিন্তাই জন্ম দিতে পারে ‘স্পেশাল রিলেটিভিটি’ তত্ত্বের। কল্পনার অবাধ উড়াল, অলীক উল্লম্ফনই সভ্যতাকে আগাইয়া লইয়া যায়। ওই ক্ষমতাই সান্তা ক্লজের পক্ষ হইতে শিশুদের শ্রেষ্ঠ উপহার। |