বিশ্ব জুড়ে বামপন্থার সংজ্ঞাকে প্রসারিত করার নানা প্রয়াস চলছে,
বঙ্গীয় বাম বুদ্ধিজীবী
এক মনে বামপন্থাকে সংকীর্ণতর করার আত্মঘাতী প্রবচন দিতে ব্যস্ত। লিখছেন
পঞ্চানন নিন্দা |
মনুষ্যকুলে বুদ্ধিজীবী শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিজীবীকুলে বামপন্থী। বাম গৃহস্থীতে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সর্বশ্রেষ্ঠ। বুদ্ধিজীবী মাত্র উপদেষ্টা, বাম বুদ্ধিজীবীরা বামপন্থী রাজনীতির শুভচিন্তক, আর বাঙালি দপ্তরি বাম বুদ্ধিজীবী শুভাশুভ মন্ত্রণায় সমান পারঙ্গম। বিশেষত নিজের পায়ে কুড়ুল মারা শেখাতে এঁদের জুড়ি নেই। টাটকা নমুনা, প্রয়াত জ্যোতি বসু জন্মশতবার্ষিকী। কোনও এক রাজনেতা বলে ফেলেছেন, এই মহতী কমর্যজ্ঞের উদ্বোধনী বক্তৃতাটির জন্য অমর্ত্য সেনকে বলা হোক। সঙ্গে সঙ্গে আস্তিন গুটিয়ে, গলার শিরা ফুলিয়ে বাম বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠ-বিস্ফোরণ: না, অমর্ত্য কিছুতেই নয়। প্রয়াত জ্যোতি বসু নামাঙ্কিত অনুষ্ঠানে কোনও ‘প্রকৃত বামপন্থী’কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাকা হোক। ‘প্রকৃত বামপন্থী’টি কে, সেটা অবশ্য তাঁকে নিজে মুখে বলতে হয়নি, সবাই বুঝে নিয়েছেন!
প্রকৃত বামপন্থী কী? এমন কোনও বস্তু কি আদৌ আছে? ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের সময় উদ্ভূত লব্জটি গত সওয়া দু’শো বছরে তার মূল সংজ্ঞা ছাড়িয়ে ব্যাপকতর হয়েছে। আজ বাম বলতে কেউ রাজার বিপক্ষবাদী বা সাবেক ফরাসি বিপ্লবের পক্ষধর বোঝে না। বামপন্থী এখন একটা ব্যাপক অভিধা: প্রগতিশীল, কমিউনিস্ট সামাজিক উদারবাদী, পরিবেশবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, সমাজতন্ত্রী থেকে শুরু করে নৈরাজ্যবাদী পর্যন্ত নানা গোষ্ঠীই ‘বামমার্গী’। কেননা, এঁরা সকলেই বৃহদর্থে সমাজের নীচের ধাপের, ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পক্ষে সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন পথ নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, এঁদের অবস্থানটা হল বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোটাকে এমন ভাবে বদলানো, যাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনাগুলো দূর করা যায় এবং বঞ্চিতরা নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রে অংশ নিতে পারেন। |
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় দপ্তরি বাম বুদ্ধিজীবীর গৌরব হল, তিনি প্রথমে বাঙালি। হরিচরণ ‘বাম’-এর যে-সব অর্থ দিয়েছেন, তাতে দিক বা পার্শ্ব হিসেবে ‘বাম’-এর উল্লেখ থাকলেও সেই সঙ্গে আরও অনেক কিছুর কথা বলেছেন। এদের মধ্যে প্রতিকূল, রুদ্র, দুর্দৈব, বক্র, ক্রূর, তির্য্যক প্রভৃতি নঞর্থক ভাবে গৃহীত অর্থের পাশাপাশি অবার সুন্দর, চারু, মনোজ্ঞ ইত্যাদি ভাল ভাল ব্যাপারও আছে। বাংলা বাম বোধহয় পৃথিবীতে ব্যাপকতম শব্দ, যার মধ্যে এত বিচিত্র ধারণা ও বস্তুর সমাহার! কিন্তু দপ্তরি বাম বুদ্ধিজীবী এত জটিলতায় নেই, অশুভসূচক অভিধাতেই সে আবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী রাজনীতি যখন সর্বনাশের পথে শনৈঃ শনৈঃ ধাবমান, তখন ক্ষমতার ক্ষীর-ননী খাওয়া নধর বুদ্ধিজীবী তাকে হুঁশিয়ার করা তো দূর, বরং হাততালি দিয়ে পতনের গতিবৃদ্ধিতে উৎসাহ দিয়ে গেছে। মরিচঝাঁপি, কেশপুর, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়; বিরোধী নিধন, দুর্বৃত্ত পোষণ, ধর্ষণ; শাসন-নিষ্ক্রিয়তা, দরিদ্র-নিপীড়িতদের ক্ষমতায়নের বিপরীতে সমাজের প্রাচীন উচ্চবর্গীয় কাঠামোটাকে মজবুত করার মতো কুকর্মের শৃঙ্খলা কখনওই দপ্তরি বুদ্ধিজীবীকে প্রতিবাদ তো দূর, সামান্য সমালোচনাতেও প্রণোদিত করেনি।
বিপরীত বুদ্ধিতেই সে বাম। অতএব, মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক পুষ্টিহীনতায় শীর্ণ বামপন্থীদের বল সংগ্রহের জন্যই, আদর্শে না হোক, অন্তত কৌশলগত কারণেই বন্ধুবৃত্তটা বাড়ানো দরকার। প্রয়াত জ্যোতি বসু দপ্তরি বামদের সম্পত্তি, সেটা সবাই জানে। এই ধারণা গড়ে ওঠার পিছনে জ্যোতিবাবুর নিজের দায়িত্বও কম নয়, তিনিও তো ছিলেন বামপন্থার সংকীর্ণ রূপটার কারিগরদের এক জন। এটাই তাঁর নেতৃত্বক্ষমতাকে দলের ঊর্ধ্বে উঠে সমগ্র বাঙালির নেতা হয়ে উঠতে দেয়নি। এখানেই বাম বুদ্ধিজীবী তাঁর ভূমিকা পালন করতে পারতেন, দলীয় প্রতাপজনিত অন্ধতার আচ্ছাদন দূর করে লোকসাধারণের নেতা হয়ে ওঠার প্রয়োজনটা স্পষ্ট তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো ‘স্বেচ্ছাবৃত শৃঙ্খলের পাকে’ বন্দি— না, সব্যসাচী দেবের কবিতার কর্ণের মতো ‘অন্নের দাসত্ব’-র টানে নয়, বরং বুদ্ধির অনুশীলনহীনতায়। ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বরগুলোর লাঞ্ছনা ও অপমান এঁরা দেখেছিলেন, ‘শিক্ষা’ নিয়েছিলেন, অতএব— প্রশ্ন নয়, আনুগত্য। পরিস্থিতি বদলেছে, কিন্তু দীর্ঘ অভ্যাসে বুদ্ধি নিষ্ক্রিয় এবং দৃষ্টি আচ্ছন্ন হলে সে ব্যাধির নিরাময় অতি কঠিন। সুতরাং বিশ্বপৃথিবী যখন বামপন্থার সংজ্ঞাকে প্রসারিত করার নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, বঙ্গীয় বাম বুদ্ধিজীবী তখন বামপন্থাকে সংকীর্ণতর করার আত্মঘাতী প্রবচন দিয়ে যাচ্ছে। আভিধানিক অর্থে অমর্ত্য সেন বামপন্থী কি না জানা নেই। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষে দরিদ্র, অবদমিত, ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরে থাকা নিষ্পেষিত জনতার পক্ষে যে সব কণ্ঠস্বর সবচেয়ে জোরালো, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্যটি অমর্ত্য সেনের। স্বাভাবিক ভাবে, যাঁর বিরুদ্ধে আজকের ভারতের দক্ষিণপন্থীদের সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ, তিনি ‘অ-প্রকৃত বামপন্থী’ অমর্ত্য সেন। প্রয়াত জ্যোতি বসুর অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হলেন কি না, সেটা দিয়ে তাঁর অবস্থানের বিচার হয় না— তাঁর অবস্থানের বিচার করছে গতিময় ধরিত্রী। |