এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে গিয়ে রোগী দেখার ডাক এলে তা অগ্রাহ্য করে ফেলে রাখা যাবে না। দ্রুত সেই বিভাগে গিয়ে রোগীকে দেখে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য এই নির্দেশ জারি করছে স্বাস্থ্য দফতর। বিভিন্ন হাসপাতালে কল বুক পাঠানোর পরেও চিকিৎসকেরা রোগী দেখতে না যাওয়ায় রোগীদের হাসপাতাল-বাসের মেয়াদ বেড়ে যাচ্ছে বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে খবর। ফলে বছর শেষে কত জন রোগীর চিকিৎসা হল, তার হিসেব নিতে গিয়ে সন্তোষজনক কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সেই কারণেই হাসপাতালের ‘বেড অকুপ্যান্সি রেট’ বাড়ানোর জন্য চিকিৎসকদের আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
সীমিত শয্যার মধ্যেই কত বেশি রোগীকে পরিষেবা দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্তাদের ভাবনাচিন্তা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাবনাচিন্তা-আলোচনার মধ্যেই স্বাস্থ্যকর্তাদের সামনে যে কারণগুলি উঠে এসেছে, তার মধ্যে একটি হল এক শ্রেণির চিকিৎসকের অসহযোগিতা। এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ভর্তি রোগীকে দেখে মতামত বা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে যাঁদের মধ্যে ঘোর অনীহা কাজ করছে। ফলে লিখে পাঠানোর পরে সাত-দশ দিন কেটে গেলেও অন্য বিভাগের ডাক্তারদের দেখা মিলছে না। কখনও কখনও আবার ভিজিটিং ডাক্তারদের পরিবর্তে মেডিক্যাল পড়ুয়াদের পাঠানো হচ্ছে রোগী দেখার জন্য। এর ফলে রোগ তো সারছেই না, উপরন্তু জটিলতা বাড়ছে। তাই বেড়ে যাচ্ছে রোগীর হাসপাতাল-বাসের মেয়াদও। কিছুতেই বাড়ানো যাচ্ছে না মেডিক্যাল কলেজগুলির ‘বেড অকুপ্যান্সি রেট’।
সম্প্রতি কলকাতার কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। বিভিন্ন হাসপাতালের একাধিক বিভাগের চিকিৎসকেরা অন্যান্য বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। তার পরেই বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন কর্তারা।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দ্রুত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ছেড়ে দিলে অন্য রোগী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন। এমনিতেই শয্যার এত সঙ্কট, সেখানে একই রোগী দিনের পর দিন শয্যা আটকে থাকলে অন্যদের সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের সক্রিয় হতে হবে।”
তবে কাজটা যে কঠিন, তা তাঁরাও স্বীকার করে নিয়েছেন। কারণ, নির্দেশ দিলেও চিকিৎসকেরা তা মানছেন কি না, সে ব্যাপারে নজরদারি চালানোর কোনও ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত গড়ে তোলা যায়নি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার কথায়, “এ ক্ষেত্রে ওঁদের সদিচ্ছার উপরেই আমাদের অনেকটা নির্ভর করতে হয়, হবেও।”
ঠিক কী ধরনের অভিযোগ এসেছে স্বাস্থ্য ভবনে? এসএসকেএমের সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসকের অভিযোগ, “অস্ত্রোপচারের পরে আমার অধীনে ভর্তি এক রোগিণীর অন্যান্য কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক যাতে এসে তাঁকে দেখে যান, সে ব্যাপারে ওই বিভাগে খবরও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু টানা সাত দিনের মধ্যে এক বারও সিনিয়র চিকিৎসক আসার সময় পাননি। পাঁচ দিনের মাথায় এক জুনিয়র ডাক্তারকে পাঠানো হয়েছিল।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রী-রোগ বিভাগের এক চিকিৎসকের অভিযোগ, এক রোগিণীর মানসিক কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁরা সাইকিয়াট্রি বিভাগে খবর পাঠান। কিন্তু পাঁচ দিন কেটে যাওয়ার পরেও সেখানকার ডাক্তার আসেননি। ফলে রোগিণীকে ছুটি দিতে বেশ কয়েক দিন দেরি হয়ে যায়।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের শিশু শল্যচিকিৎসা বিভাগের এক চিকিৎসক অভিযোগ এনেছেন শিশুদের মেডিসিন বিভাগের উদ্দেশে। সেখান থেকে নাকি ডাক্তারদের বারবার ডেকেও পাওয়া যায় না। আবার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে পুরুষদের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসকের অভিযোগের লক্ষ্য অর্থোপেডিক বিভাগ। এক চিকিৎসকের কথায়, “মেডিসিন-এ ভর্তি রোগীর হাড় ভেঙে যাওয়ার পরে প্লাস্টার হয়েছিল, কিন্তু কোনও অর্থোপেডিক ওই রোগীকে দেখতে আসেননি। কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার অভিযোগ করেও ফল হয়নি।” এ ভাবেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকদের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ কর্মসংস্কৃতি নষ্ট করছে বলেও রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ মনে করছেন। |