বিতর্ক উস্কে দিয়ে আবার প্রশ্নের মুখে ‘নিষ্কৃতি মৃত্যু’
বিতর্কটা দীর্ঘদিনের। রোগের কারণে শারীরিক ভাবে জড়বস্তুতে পরিণত হওয়া ব্যক্তির মস্তিষ্ক কিছুটা হলেও জীবিত থাকলে তাঁর ভেন্টিলেটর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কি বাড়ির লোকজন নিতে পারেন? যে বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিয়েছে ছ’বছরের তেহরিনের ঘটনায়। চিকিৎসকেরা বলছেন, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা শূন্য হলে এ ভাবে বাঁচিয়ে না রেখে আইন এড়িয়ে ভেন্টিলেটর বন্ধ করা হয় অনেক ক্ষেত্রেই। এ ধরনের ‘নিষ্কৃতি-মৃত্যু’তে সায় রয়েছে সমাজতাত্ত্বিকদেরও। তবে মানছেন না মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের মতে, ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দেওয়া এ ক্ষেত্রে খুনেরই সামিল।
বাংলাদেশের শ্রীহট্টের গোপালগঞ্জ থানার নিমাদল থেকে থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসে তেহরিনকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বাবা-মা নুরুল আবসার ও সায়রা বেগম। ২৪ সেপ্টেম্বর কোমায় চলে যায় তেহরিন। শরীরের সমস্ত মাংসপেশী ও স্নায়ু বিকল হয়ে যায়। শুধুমাত্র মস্তিষ্কের সামান্য কিছু কোষ বেঁচে আছে।
প্রায় তিন মাস হতে চলল পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি শিশু হাসপাতালে ছোট্ট মেয়ে ভেন্টিলেশনে রয়েছে। গলায় ছিদ্র করে ঢোকানো অক্সিজেনের নল, নাক দিয়ে যাচ্ছে তরল খাবার। শরীরে সাড় নেই। মাঝেমধ্যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ দু’টো অর্ধেক খোলে আর ঠোঁটটা একটু ভাঙে, ফের অচেতন হয়ে যায়। ভেন্টিলেটর থেকে বার করে নিলেই তার মৃত্যু অনিবার্য। এখানেই ফের নৈতিক ও আইনি প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কোনও রোগীর সমস্ত মাংসপেশী-স্নায়ু বিকল হওয়া সত্ত্বেও যদি মস্তিষ্কটি জীবিত থাকে, সে ক্ষেত্রে বাড়ির লোক বা চিকিৎসকদের কী করণীয়?
হাসপাতালের শয্যায় তেহরিন। —নিজস্ব চিত্র।
মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞ অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “নিষ্কৃতি মৃত্যু নিয়ে বহু আলোচনাতেও কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। ১২-১৪ বছর কেউ ভেন্টিলেশনে থাকলে সেটা কত দূর মানা সম্ভব বা উচিত, এটা এত স্পর্শকাতর বিষয় যে, সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। আইনও কোনও কোনও ক্ষেত্রে অন্ধ। দেশের আইন মানতেই হবে।”
তেহরিনের তিন চিকিৎসক অগ্নিশেখর সাহা, অপূর্ব ঘোষ ও প্রভাসপ্রসূন গিরি জানিয়েছেন, ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো দেশে হাসপাতালে চিকিৎসকদের বোর্ড তৈরি হয়। তাঁরা রোগীর পরিজনদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ভেন্টিলেটর-সাপোর্ট বন্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের আইন তার স্বীকৃতি দেয় না। যখন দেখা যায়, ভেন্টিলেটর থেকে বেরিয়েও রোগী জড়বস্তু হয়ে বেঁচে থাকবেন বা তাঁর ‘কোয়ালিটি লাইফ’ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তেমন ক্ষেত্রে অনেক সময়ে আইনের চোখ এড়িয়ে বাড়ির লোকের অনুমতি নিয়ে ভেন্টিলেটর বন্ধ করা হয়। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লেখা হয়, ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’।
সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী সেই ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কোনও আশা না থাকলে তাঁকে যন্ত্রের সাহায্যে টিকিয়ে রাখা আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অযৌক্তিক। এটা রোগীর আত্মীয়দের পক্ষে আর্থিক ও মানসিক চাপেরও বটে। তাঁর কথায়, “দরকার আইন ও মানসিকতার পরিবর্তন। দিনের পর দিন কেউ কাজ বন্ধ করে ভেন্টিলেশনে থাকা জড়বস্তুতে পরিণত রোগীর পিছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করতে পারবে? তার উপরে কেউ যদি তেহরিনের মতো বিদেশ থেকে এসে ভেন্টিলেশনে চলে যান, তা বোঝার উপরে শাকের আঁটির মতো হবে।” তিনি আরও বলেন, “প্রাচীন কালে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জঙ্গলে বানপ্রস্থে পাঠিয়ে দেওয়া হত, কারণ সমাজে তাঁদের ‘উৎপাদনশীলতা’ ফুরিয়ে যেত। তা হলে এই প্রথাকেও অমানবিক বলা উচিত।”
এর বিরোধিতা করেছেন মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞ নিশীথ অধিকারী। তাঁর সাফ বক্তব্য, “সামাজিক নীতি বলে কোনও বস্তু থাকবে না? কেউ সমাজের পক্ষে কাজের বা উৎপাদনশীল হতে পারত। ভাগ্যদোষে সে ভেন্টিলেটরে পড়ে আছে বলে কি তার থেকে সমাজ হাত ঝেড়ে নিতে পারে! তখন সেই রোগীর সহযোগী চিকিৎসা বন্ধ করলে ৩০২ ধারায় খুনের অভিযোগই দায়ের হবে।”
ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় ও পার্থসারথি ভট্টাচার্য জানান, বিদেশে বহু জায়গায় বিশেষত স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে সরাসরি মৃতপ্রায় রোগীর ভেন্টিলেটর বন্ধ না-করে রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে ‘সহযোগী চিকিৎসা’ বন্ধ করার প্রচলন খুব বেশি। যেমন, রোগীর কোনও সংক্রমণ দেখা দিলে অ্যান্টিবায়োটিক না-দেওয়া বা তাঁর কিডনি কাজ করছে না বুঝেও ডায়ালিসিস চালু না-করা। ভারতে ‘সহযোগী চিকিৎসা বন্ধ’-এর ব্যাপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনওটাই স্পষ্ট বলা নেই। তাই চিকিৎসকেদের মতে, এক জন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বোর্ড বসিয়ে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিদেশি রোগীর ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হবে কি না, কেউ তার সদুত্তর দিতে পারেননি।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.