|
|
|
|
নিষ্কৃতি-মৃত্যুতে সায় দিল রাজ্যের কমিটি
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
ছেলে ভেঙ্কটেশের নিষ্কৃতি-মৃত্যু চেয়ে আদালতে গিয়েছিলেন মা সুজাতা। অনুমতি পাননি। বান্ধবী অরুণা শনবাগের নিষ্কৃতি-মৃত্যু চেয়ে আবেদন করেছিলেন পিঙ্কি ভিরানি। তাঁকেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু দেশ জুড়ে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে তর্কবিতর্ক-আলোচনা বন্ধ হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকার এ বার নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে একটি পৃথক আইন আনার কথা ভাবছে। এমন একটি স্পর্শকাতর আইনের খসড়া তৈরির আগে বিভিন্ন রাজ্যের মতামত চেয়ে পাঠিয়েছে তারা। পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞ কমিটি কিন্তু নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকার
দেওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছে। রাজ্য সরকার এখনও তার সিদ্ধান্ত জানায়নি।
গত ৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন রাজ্যের মতামত জানতে চেয়ে চিঠি দেয় কেন্দ্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্যভবনে সহকারী স্বাস্থ্য অধিকর্তা (অঙ্কোলজি) দীপা বসু-র কাছে দশ সদস্যের ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা গিয়েছে। সেখানে কমিটি বলেছে, ‘অতি বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনও রোগীকে নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকার দেওয়া যেতেই পারে।’ |
|
এই গল্প কি সত্যি হবে অদূর ভবিষ্যতে? |
কেন? রাজ্যের কাছে কমিটির সুপারিশ: ‘ভারতীয় সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। তাই অতি বিশেষ পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত শারীরিক যন্ত্রণা ও কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেতে তাঁদের নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকারও থাকা উচিত।’ কমিটির মতে, হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন একাধিক চিকিৎসকের প্যানেল এবং উচ্চ আদালতের সুপারিশ অনুযায়ী এই পদক্ষেপ কার্যকর করা যেতে পারে। এই সুপারিশ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “রিপোর্ট সবে জমা পড়েছে। তাদের সুপারিশ স্বাস্থ্য ও আইন দফতর খতিয়ে দেখবে। তার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
কমিটির প্রধান, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ির ব্যাখ্যা, “সিদ্ধান্তে আসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। তবু আমরা একমত হয়েছি যে, এক জন রোগী যখন অমানুষিক কষ্ট ভোগ করছেন এবং চিকিৎসদের পর্যবেক্ষণে তাঁর
সুস্থ হওয়া কার্যত অসম্ভব, এমন
চূড়ান্ত অবস্থায় নিষ্কৃতি-মৃত্যু বৈধ করা যেতে পারে।’’
প্রসঙ্গত অরুণা শনবাগ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট পিঙ্কির আবেদন খারিজ করলেও বিশেষ ক্ষেত্রে পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যু বা প্যাসিভ ইউথেনেশিয়ার অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল। ‘পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যু’ মানে, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া। নতুন আইন তৈরি হলে প্রত্যক্ষ বা অ্যাক্টিভ নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকারও মিলবে বলে মনে করা হচ্ছে। আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, নিষ্কৃতি-মৃত্যুতে সম্মত কোনও রোগীকে সরাসরি ইঞ্জেকশন বা ওষুধ দিয়ে মেরে ফেলা হলে তা ‘প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যু’র আখ্যা পাবে। যার উদাহরণ রয়েছে সঞ্জয় লীলা বনশালির ‘গুজারিশ’ ছবিতে। সেখানে দীর্ঘদিন পঙ্গু থাকা জাদুকর ইথান মাসকারেনহাসকে (ঋ
ত্বিক রোশন) তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে মৃত্যু এনে দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিকা তথা নার্স সফিয়া ডিসুজা (ঐশ্বর্যা রাই)।
নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গের মতো দেশে নিষ্কৃতি-মৃত্যু বৈধতা পেয়েছে। এ দেশেও নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে আইন তৈরির প্রক্রিয়া আগে এক বার শুরু হয়েছিল। ২০০৬-এ এ ব্যাপারে একটি বিল তৈরিও হয়। কিন্তু তার পর বিষয়টি ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। ২০১১ সালে অরুণা শনবাগ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তাদের মতামত জানানোর পরে সরকার আবার নড়েচড়ে বসেছে। প্রায় ৩৮ বছর ধরে মুম্বইয়ের কেইএম হাসপাতালে জীবন্মৃত অবস্থায় রয়েছেন অরুণা। ডাক্তারদের মতে, অরুণা মারা না গেলেও তাঁর শরীরে কোনও সাড় নেই! ২০১২-র অগস্টে জাতীয় আইন কমিশন পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে একটি ৬৫ পাতার রিপোর্ট তৈরি করেছে। সেখানেও নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে আলাদা আইন তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। এর পরই সব রাজ্যের মতামত জানতে চাইছে কেন্দ্র।
পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোগীর নিষ্কৃতি-মৃত্যুর ব্যাপারে কোনও এক জন চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন না। রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসকদের একটি প্যানেল থাকবে। তাঁরা রোগীর অবস্থা পরীক্ষা করে রায় দেবেন। এর পর বিষয়টি যাবে হাইকোর্টে। সেখানে আর এক দল চিকিৎসক সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারে বিচারপতিদের সাহায্য করবেন। তার পর হাইকোর্ট তার রায় ঘোষণা করবে।
মেডিকো-লিগাল বিশেষজ্ঞ নিশীথ অধিকারী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও শেখর বসু-র মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, “রোগী যতই অসাড় অবস্থায় মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে থাকুন, তাঁকে নিষ্কৃতি-মৃত্যু দেওয়া ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা অমানবিক।” রাজ্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি কেন শুধুমাত্র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকদের নিয়েই গঠিত হল, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। |
|
|
|
|
|