পিচ উঠে প্রায় চষা জমির চেহারা। মাঝেমধ্যেই বিশাল গর্ত। গর্তে পড়ে হয় ‘পাত্তি’ (সাসপেনশন) ভাঙছে, না হয় স্রেফ উল্টে যাচ্ছে গাড়ি। দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে। যানজট হচ্ছে। গর্ত থেকে ওড়া ধুলোয় ঢাকা পড়ছে আশপাশের বাড়ি। যাতায়াতের বিচারে ‘দুস্তর পারাবার’ হয়ে ওঠা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক মেরামতি ও চওড়া করা নিয়ে সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথরিটি’ (এনএইচএ)-কে কিছু নির্দেশও দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু তার পরেও কাজ কত দ্রুত হবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
এ বছর বর্ষার পরে জাতীয় সড়কটির এমন দশা হয়েছে যে তা দিয়ে এক সময় চলাচল করা একাধিক রুটের বেসরকারি বাস বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকেরা। রানাঘাটের মিশন গেট থেকে গাংনাপুরের পাটুলি এবং হরিণঘাটা থানার বড় জাগুলিয়ায়, বহরমপুরের ভাকুড়ি থেকে পঞ্চাননতলা, বহরমপুর থেকে নবগ্রামের কানফলার মতো বেশ কিছু এলাকায় জাতীয় সড়কের অবস্থা শোচনীয়। বারাসত থেকে বড় জাগুলিয়াগামী ৮৭ নম্বর বাস সিন্ডিকেটের সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত বলেন, “ওই রাস্তা দিয়ে এক বার গেলে ভয়ে আর যেতে ইচ্ছা করে না। এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে তিন গুণ সময় লাগছে। ইতিমধ্যে আমাদের ২৮টি বাসের জায়গায় চলছে ১৬টি। বাকি বাস ভেঙে পড়ে রয়েছে।” শুক্রবারও ওই জাতীয় সড়কে ঘটেছে একটি দুর্ঘটনা। রায়গঞ্জের কুলিক সেতু এলাকায় খন্দে পড়ে যায় কালুয়া বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তির বাইকের চাকা। রাস্তায় পড়ে গিয়ে ট্রেলারের চাকায় পিষে মারা যান তাঁর স্ত্রী অধিকা ও সাত মাসের ছেলে।
কেন এই পরিস্থিতি? |
আমডাঙার কাছে মীরহাটিতে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দশা এ রকমই। ছবি: সুদীপ ঘোষ |
প্রাথমিক ভাবে এনএইচএ কর্তারা বলেন, “এ বার নভেম্বরের গোড়া পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির জল থাকলে রাস্তার কাজ করা যায় না।” কিন্তু তার পরে তো প্রায় দু’মাস হতে চলল? জবাব দিতে গিয়ে এনএইচএ-কর্তারা ওই সড়ককে চার লেন করার প্রকল্পটির কথাই তুলছেন।
দমদম থেকে ডালখোলা পর্যন্ত বিস্তৃত এই জাতীয় সড়ক লম্বায় প্রায় ৪৪৩ কিলোমিটার। তার মধ্যে বারাসত থেকে ডালখোলা পর্যন্ত রাস্তা চার লেনের হওয়ার কথা। ২০০৯ সালে এ জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এনএইচএ সূত্রে জানা গিয়েছে, একাধিক পর্যায়ে ওই কাজ হওয়ার কথা থাকলেও জমি-জটে প্রথম পর্যায়ের (বারাসত থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার) কাজ কিছু মাত্র এগোয়নি। ওই দফতরের কর্তাদের দাবি, “আমাদের দায়িত্ব রাস্তাটা চার লেন করা। এখন যে দু’লেনের রাস্তাটা আছে, সেটাকে পাকাপাকি মেরামত করার কোনও মানে হয় না। বাজেট-বরাদ্দও নেই। তবু মানুষের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রের অনুমতি নিয়ে যতটা সম্ভব প্যাচওয়ার্ক করা হয়।”
জাতীয় সড়ক দিয়ে নিত্য যাতায়াতকারীদের একটা বড় অংশের অভিজ্ঞতা, ‘প্যাচওয়ার্ক’ মানে হল ‘জোড়াতাপ্পি’। কিন্তু তা বেশি দিন টেকে না। খন্দ-পথে তাঁদের ভোগান্তি চলতেই থাকে। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল দশা কবে দূর করা যাবে, তা নিয়ে সম্প্রতি সংশয় ধরা পড়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেও। গত মাসেই উত্তর দিনাজপুর সফরে গিয়ে তিনি বলেন, “বেহাল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক আমরা যতটা সম্ভব সারাচ্ছি। এটা এনএইচএ কর্তৃপক্ষের করা উচিত। কিন্তু ওঁরা তা ঠিকমতো করছেন না বলে সমস্যা হচ্ছে। কোথাও কোথাও রাস্তা চওড়া করার জন্য জমি পেতেও জটিলতা হচ্ছে। ওই জাতীয় সড়কের হাল তাড়াতাড়ি ফেরানোর জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।”
ইতিমধ্যে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক নিয়ে অঞ্জন ভট্টাচার্য নামে এক আইনজীবী কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি মামলা দায়ের করেন। আদালতে তিনি বলেন, “বারাসত থেকে মালদহ পর্যন্ত ওই জাতীয় সড়ক এক বিপদের খনি। অথচ, এ বিষয়ে নীরব এনএইচএ। তাই আদালত দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী এ রকম একটি প্রধান রাস্তা ভাল করার জন্য ব্যবস্থা নিক।” হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, তিন মাসের মধ্যে এনএইচএ-কে বারাসত থেকে মালদহ পর্যন্ত ওই জাতীয় সড়কের মেরামতির কাজের অগ্রগতি জানাতে হবে হাইকোর্টে। গত মঙ্গলবার ওই নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গেই আদালত জানতে চেয়েছে, ওই রাস্তাটিকে চার লেনের করতে এনএইচএ কী ব্যবস্থা নিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, ওই রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে কাজে এনএইচএ যেন কোনও বাধাকে
গুরুত্ব না দেয়। যে কোনও মূল্যে এই রাস্তা চওড়া করতে হবে। রিপোর্টে এই রাস্তা চওড়া করার বিষয়েও জানাতে হবে।
এনএইচএ-র চিফ জেনারেল ম্যানেজার (কলকাতা আঞ্চলিক অফিস) অজয় অহলুওয়ালিয়া অবশ্য বলেন, “নির্দেশ এখনও হাতে পাইনি। হাতে পেলে, তবেই এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সম্ভব।” অবশ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, আদালতের নির্দেশের দিনই জাতীয় সড়কের বারাসত থেকে মালদহ ‘সেকশন’-এর প্রকল্প আধিকারিককে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন এনএইচএ কর্তৃপক্ষ। তবে, উত্তর ২৪ পরগনায় জমি অধিগ্রহণ করে রাস্তাটিকে চার লেনের করা যে সহজ হবে না তা ঠারেঠোরে স্বীকার করছেন এনএইচএ-র কর্তারা। সংস্থা সূত্রের খবর, প্রথম পর্যায়ে ওই জেলায় মোট ১৮ কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করতে ২১টি মৌজার জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চারটি মৌজায় জমি মিলেছে। এনএইচএ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, উত্তর ২৪ পরগনায় জাতীয় সড়ক ৪০ ফুটের মতো চওড়া। কিন্তু চার লেন করতে গেলে অন্তত ৪৫ মিটার (১৪৮ ফুট) চওড়া করতেই হবে।
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তর ২৪ পরগনায় ওই জাতীয় সড়ককে চার লেনের করতে উদ্যোগী হয় বামফ্রন্ট সরকার। এ নিয়ে একাধিক প্রশাসনিক বৈঠকও হয়। কিন্তু জমি অধিগ্রহণে তৃণমূল বাধা দেয় বলে অভিযোগ। সর্বদলীয় বৈঠকেও বিষয়টি মেটেনি। রাজ্যে পালাবদলের পরে এনএইচএ কর্তৃপক্ষ ফের পুরনো প্রকল্প নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে তদ্বির করে। উদ্যোগী হয় জেলা প্রশাসন। সর্বদল বৈঠকে জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারেও সব দল রাজি হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। কিন্তু শুড়িপুকুর থেকে আমডাঙা পর্যন্ত জাতীয় সড়কের দু’পাশে জমির মাপজোক শুরু হতেই বাধা দেয় স্থানীয় বাসিন্দা ও পাশের দোকানদের একাংশকে নিয়ে গড়ে ওঠা ‘ভূমি ও ব্যবসা রক্ষা কমিটি’। ওই কমিটির সদস্য আমডাঙা পঞ্চায়েতের কাছারি মোড়ের বাসিন্দা মহম্মদ কুতুবউদ্দিন মণ্ডল বলেন, “কাঠের মিল, বাড়ি ও জমি মিলে আমার প্রায় ৮ শতক জমি রাস্তার জন্য চলে যাবে। প্রতি শতক ফাঁকা জমির দামই এখন ৩ লক্ষ টাকা। অথচ, সরকার শতকপিছু মাত্র ৩৩ হাজার টাকা করে দিচ্ছে। এতটা ক্ষতি আমরা মেনে নেব কী করে?” ইতিমধ্যে ফের জমি অধিগ্রহণের নোটিস পেয়েছেন তাঁরা। জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল বলেন, “জমি-জট কিছুটা কেটেছে। ২০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। ৫ জন চেকও নিয়েছেন।”
আদালতের নির্দেশ এখন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের হাল ফেরাতে পারে কি না, তাই দেখার।
|