দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার।
বুধবার রাতের পরে দুই গ্রামের সেই ব্যবধান ঘুচেছে। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা কোথায় একটা মিলিয়ে দিয়েছে দু’টি গ্রামকেই। পাশাপাশি রয়েছে প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষোভ। দুই গ্রামের ঘরে বাইরে বাসিন্দাদের আলোচনাতেই তা স্পষ্ট। প্রত্যেকেরই দাবি, তারাপীঠ-কাণ্ডে সাত জনের মৃত্যুর দায় রাজ্য সরকার কোনও ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না।
তারাপীঠ-কাণ্ডে চার সন্তানকে হারিয়েছে রামপুরহাট থানার কুতুবপুর গ্রাম। গ্রামে হিন্দু ও মুসলিম পরিবারগুলি মিলেমিশে বাস করেন। ঘটনার দিন সৌহার্দ্যের সেই রীতি মেনেই গ্রামের এক হিন্দু প্রৌঢ়ের শবদাহ করতে শ্মশানযাত্রী হয়ে তারাপীঠে গিয়েছিলেন আলিম শেখ। পেশায় ভ্যানচালক আলিম গ্রামের পরোপকারী ছেলে বলেই পরিচিত ছিলেন। দাহ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে অন্যদের সঙ্গে তিনিও শ্মশান লাগোয়া ওই দোকান থেকে মদ কিনে খেয়েছিলেন। চোলাই নয়, সরকারের অনুমতি নিয়ে তৈরি হওয়া দেশি মদ খেয়ে বাবার এই মৃত্যুকে কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না একমাত্র ছেলে জিয়াউল হক। এ দিন সম্পূর্ণ দিশাহারা হয়ে বললেন, “বাবা রোজ গ্রাম থেকে ভ্যান নিয়ে রামপুরহাটে কাজে যেতেন। সেখান থেকে যা আয় হত, তা দিয়েই আমাদের সংসার চলত। এখন পরিবারের সাত সদস্যের পেট কী করে ভরাব, ভেবে কুল পাচ্ছি না।” |
কুতুবপুরে মৃতদের পরিজনদের কাছে সিপিএম সাংসদ। —নিজস্ব চিত্র। |
দুই ছেলে আপেল আর গৌতমকে হারিয়ে যন্ত্রণায় পুড়ছেন কুতুবপুরেরই প্রৌঢ়া পাতাসী মাল। আপেল মালের স্ত্রী অনসূয়াদেবীর প্রশ্ন, “আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। এ বার স্বামীকেও হারাতে হল। এখন তিন নাবালক ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় দাঁড়াব?” অথচ দুই ভাই কোনও অপরাধ করেননি। সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত কারখানায় তৈরি হওয়া দেশি মদ কিনে খেয়েছিলেন। তা হলে, এই মৃত্যুর দায় কার? এই প্রশ্নটাই তুলছেন কদর আলিরা। তাঁর কথায়, “সরকারের নজরদারি অভাবেই আজ ওই ছোটছোট ছেলেমেয়েগুলো তাদের বাবাদের হারাল।” অভিযোগ, একই কারণে আত্মীয়ার দাহে গিয়ে মারা যান মাড়গ্রামের মাঝিরার বাবলু মালও।
কুতুবপুরের মতোই ওই ঘটনায় দুই প্রিয় মানুষকে হারিয়েছে ময়ূরেশ্বর থানার মহুলা গ্রাম। বিপদে আপদে সব সময় গ্রামের পাশে থাকতেন মৃত কাঙাল লেট ও বিমল লেট। প্রশাসনের উদাসীন মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সেখানেও। সামনে দাঁড়াতেই কাঙাল লেটের স্ত্রী গঙ্গাবালী লেটের চোখ ছলছল করে উঠল। কথা বলতে পারলেন না। ১৬ বছরের ছেলে আকাশ শুধু বলল, “বাবার মৃত্যুর জন্য সরকারই দায়ী। সরকারকে তাঁর ক্ষতিপূরণ করতে হবে।” গ্রামের যুবক বাদল লেট জানান, বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ওই গ্রামে থাকা চোলাইয়ের ভাটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তার পরে গ্রামে সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশি মদের দোকান খোলে। তিনি বলেন, “ওই দোকান থেকে গ্রামের অনেকেই মদ কিনে খান। এক বাসিন্দাকে দাহ করতে গিয়ে গ্রামের ১০-১২ জনের ওই দল তারাপীঠের দোকানে থাকা একই ব্র্যান্ডের সিল করা বোতল দেখে কোনও সন্দেহ করেননি। দেশি মদ ভেবেই তা মুখে দিয়েছিলেন। কে জানত, ওই মদ খেয়েই তাঁদের মরতে হত।” ক্ষোভে ফুটছেন মনোজ রায়, অমল লেটরা। তাঁদের অভিযোগ, “তারাপীঠ শ্মশান লাগোয়া ঠান্ডা পানীয় দোকানে যে অবাধে দেশি মদ বিক্রি হয়, তার খবর কি পুলিশ-আবগারি দফতরের কাছে ছিল না? সব জানতেন। তার পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই অবৈধ ব্যবসা চলার পিছনে প্রশাসন কি দায় এড়াতে পারে?”
সাত জনের প্রাণ যাওয়ার পরে হুঁশ ফিরেছে পুলিশ-প্রশাসনের। সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর দাবি, “ঘটনার পরপরই আমি পুলিশ সুপারকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।” জেলা আবগারি সুপার তপনকুমার রায় আবার বলছেন, “৭ দিন হল এই জেলার দায়িত্বে এসেছি। এসেই এই ঘটনার মধ্যে পড়েছি। এই জেলায় বেআইনি মদের কারবারকে সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করব।” এ দিকে, ঘটনার পরে এ দিনই তারাপীঠ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে সরানো হয়েছে। জেলার এসপি সি সুধাকর বলেন, “ওখানে এক জন এসআই এবং এএসআইকে পাঠানো হয়েছে। সঙ্গে আরও চার জন পুলিশকর্মীও।” গোটা ঘটনায় প্রশাসনিক গাফলতির কথা অস্বীকার করে জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলেন, “আগে কী হয়েছে তা নিয়ে কিছু বলব না। পুলিশ ও আবগারি দফতর এখন যথেষ্টই তৎপর। মৃতদের পরিজনদের প্রাথমিক ত্রাণ দেওয়া হয়েছে।” এ দিনই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেআইনি ভাবে মদ বিক্রির অভিযোগে আরও দশ জন ধরা পড়েছে। অবৈধ ভাবে বিক্রির অভিযোগে ১ হাজার লিটার দেশি মদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
এ সবেও ক্ষোভ মিটছে না কতুবপুর আর মহুলার। কুতুবপুরের স্নাতকোত্তর পাঠরত সাদ্দাম হোসেন, কলেজ পড়ুয়া উত্তম মালরা দাবি তুলছেন, এই কাণ্ডের পর সরকারের উচিত যেখানে সেখানে মদ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। একই সঙ্গে সরকারের উপরে ঘটনার দায় স্বীকার করে মৃতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর দাবিও উঠছে। কুতুবপুরেরই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আতাহার রহমান বলছেন, “রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকার দেশি মদের দোকান খোলার অনুমোদন দিচ্ছে। অথচ অবৈধ ভাবে দেশি মদ বিক্রিতে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এই কাণ্ডের দায় রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে।”
এ দিন কুতুবপুরে মৃতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পৌঁছেছিলেন সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম। তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন, “রাজ্য সরকার চোলাই খেয়ে মৃত্যু হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারাপীঠে মানুষ মরলেন দেশি মদ খেয়ে। তা হলে তাঁরা কেন কোনও ক্ষতিপূরণ পাবেন না?” |