প্রবন্ধ ...
মুসলিম সমাজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই
সাচার কমিটির রিপোর্ট পড়া না থাকলেও সাদা চোখে দেখে, সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা সম্ভব যে, ভাষা, অঞ্চল ইত্যাদির তারতম্যে পরিস্থিতির কিছুটা উনিশ-বিশ হলেও, সব মিলিয়ে এ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা পিছিয়ে পড়ছেন। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান এই তিন গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিতেই। সাক্ষরতার বিচারে তাঁদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন অধিকাংশ ধর্মীয়-সামাজিক গোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারি ক্ষেত্রে মুসলিম কর্মীর সংখ্যা নগণ্য।
আবার উদার অর্থনীতি এবং ভুবনায়নও মুসলিমদের জন্য কোনও বিশেষ সুসংবাদ বয়ে আনেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি চাকরির শর্ত হিসেবে যে ধরনের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দাবি করে, তা মুসলিম সমাজের তরুণদের কাছে সহজলভ্য নয়। বিশাল সংখ্যক মুসলমান পথেঘাটে ফেরিওয়ালার কাজ করেন অথবা অস্থায়ী দোকান চালান। কিন্তু সেই সব পেশাতে অর্থ উপার্জনের সুযোগ যেমন কম, কাজের পরিবেশও প্রতিকূল। নানা কারণেই দেশের মুসলমান এবং অ-মুসলমান মানুষদের মধ্যে অবস্থার ফারাক ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
কেন? রাকেশ বসন্ত এবং আবুসালেহ শরিফ ‘হ্যান্ডবুক অব মুসলিমস ইন ইন্ডিয়া: এমপিরিকাল অ্যান্ড পলিসি পার্সপেকটিভস’ গ্রন্থে এই বিষয়ে জরুরি আলোকপাত করেছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক মানুষই তাঁদের ধর্মীয় এবং সামাজিক পরিচয়কে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে থাকেন। তাঁদের গায়ে অনেক সময় জাতীয়তাবিরোধী তকমা লাগানো হয় এবং সেই তকমার দায় মেটাবার রাজনীতিতেও তাদের শামিল করা হয়।
কর্মসংস্থান, বাসস্থান এবং শিক্ষা সব ব্যাপারেই বঞ্চনার শিকার হতে হয় মুসলমান পরিচয়ের জন্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নটি। মুসলিম পার্সোনাল ল-এর মতো প্রসঙ্গ তুলে এনে পশ্চাত্‌পরতার জন্য সম্প্রদায়কেই দায়ী করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে আত্মপরিচয় এবং সেই সম্পর্কিত বিষয়গুলির যাথার্থ্য নিয়ে বিতর্ক চললেও সমস্যাটির গভীরতা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন উঠে আসে: কোনও আশার আলোই কি তবে নেই?
আছে। রাকেশ বসন্ত এবং আবুসালেহ শরিফ দিয়েছেন এমন কিছু তথ্য, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে অন্য ভাবে ভাবতে শেখায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে নাটকীয় কোনও উন্নতি না হলেও বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে। আবার, বিদ্যালয়ে পাঠরত মুসলিম ছাত্রদের প্রায় ৪ শতাংশ মাদ্রাসাতে পড়লেও, বর্তমানে সাধারণ প্রবণতা হল প্রথাগত স্কুলে ভর্তি হওয়া, কারণ সেগুলি থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেশি। আর একটি বিষয় হল মুসলমান সমাজের স্ত্রী-পুরুষ অনুপাত, যা দেশের গড় অনুপাতের বেশ উপরে। তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে ঈঙ্গিত রয়েছে যে, দরিদ্র এই সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ হলেও কন্যাসন্তান অসমাদৃত নয়। আবার, প্রবল দারিদ্রের মধ্যেও শিশুমৃত্যুর হার দেশের গড় হারের চেয়ে কম, যা পারিবারিক পরিসরে মুসলমান মেয়েদের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর একটা ব্যাপার বিশদ চিন্তার অপেক্ষা রাখে। মুসলিম সমাজে কর্মরত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিপুল। তাঁরা অনেকেই বহু বিচিত্র পেশার মাধ্যমে জীবনধারণের চেষ্টা করে চলেছেন। বৃত্তিশিক্ষার ক্ষেত্রে এর একটা বাড়তি তাত্‌পর্য থাকতে পারে।
বলা যায় যে, মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরেই রয়েছে সার্বিক উন্নতির বীজ। এখন জরুরি তাকে লালন করা। সরকারি স্তরে প্রচেষ্টার প্রয়োজন, যাতে মূলস্রোতের উন্নয়নের ধারা মুসলিম সমাজকেও সমান ভাবে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু কোনও অংশে কম জরুরি নয় মুসলিম সমাজের অভিমুখের পরিবর্তন। সেটা সম্ভব করতে পারেন সম্প্রদায়ের মানুষই।
ভারতীয় মুসলমান সাধারণত যে-সব সমস্যার মুখোমুখি হন, সেগুলি তিন ধরনের সমস্যার মিলিত রূপ। প্রথমটি দেশের সব দরিদ্র মানুষের সমস্যা, দ্বিতীয়টি দেশের সব সংখ্যালঘু মানুষের সমস্যা, তৃতীয়টি বিশেষত দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যা। তাই ধর্মীয় পরিচয়কে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েও মুসলিম সমাজের সমস্ত প্রতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসা উচিত সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রশ্নটিকে। প্রয়োজন অশিক্ষার জমিতে লালিত সংস্কারের মূল উচ্ছেদ, যা বহু শতক ধরে প্রচলিত থাকার ফলে সামাজিক রীতির সীমা ছাড়িয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের রূপ নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রয়োজন চিন্তনের প্রসার, যাতে ধর্ম, ধর্মীয় পরিচয় ও সমাজরীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত না হয়ে সম্প্রদায়ের চেতনায় স্থান পায় সমগ্র বর্তমান।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কথা। তিনি নিজের জীবনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, ইতিহাসের বিশেষ এক সময়ের প্রয়োজনে কী ভাবে রাজনৈতিক প্রতর্কের অভিমুখ ইসলাম ও মুসলিম সমাজের স্বাধিকারের প্রশ্নের পরিধি ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের বিষয়ে। ইতিহাসবিদ মুশিরুল হাসান সম্প্রতি আজাদের রাজনৈতিক প্রতর্কের এই অভিমুখ পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এক আলোচনাসভায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আজাদ সার্বিক উন্নয়নকেই লক্ষ্য হিসেবে রেখেছিলেন। তিনি মৌলানা; তাঁর মতো ধর্মবিশারদ বিরল। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষাকে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে স্থান না দিয়ে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার উন্নয়নে। সময়ের প্রয়োজনে চিন্তন ও কর্মের অভিমুখ পরিবর্তনের এ এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১২৫তম জন্মবর্ষে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) এই কারণেই হয়তো আরও স্মরণীয়।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.