দৃশ্য ১: বিষ্ণুপুর-রামপুরহাট সড়ক। বেহাল এই ব্যস্ত রাস্তায় প্রায় দিন দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। আর তার ঠিক পাশেই খোলা জমিতে চলছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে করেই কচিকাঁচাদের নিয়ে প্রায় ৭ বছর ধরে ওই কেন্দ্র চলছে। কোন পড়ুয়া কখন রাস্তায় গিয়ে উঠে পড়ল, তা আটকাতেই হিমশিম খাচ্ছেন মাড়গ্রামের ইনতলা পাড়ার ওই কেন্দ্রের কর্মী ও সহায়িকা।
দৃশ্য ২: মুরারইয়ের ডুমুরগ্রামে দীর্ঘ দিন ধরে গাছের তলাতেই একটি কেন্দ্র চলছে। তার কর্মী বহু কষ্টে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে রান্নার জন্য একটি চালাঘর তৈরি করেছেন। এক দিকে রান্না অন্য দিকে পড়াশোনা এই দুইয়ের টানাপোড়েনে এমন কেন্দ্রগুলির ছেলেমেয়েরা আদৌ কতটা কী শিখছে, তা নিয়েই সংশয়!
প্রশাসনের তথ্যেই উঠে এসেছে বীরভূমে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির চিত্র। ৪৫ শতাংশ কেন্দ্রেরই কোনও নিজস্ব ভবন নেই। সংখ্যাটাও খুব একটা কম নয়। জেলায় দু’ হাজারেরও বেশি এমন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলির কোনওটি প্রাথমিক স্কুলে চলছে, কোনওটি ব্যক্তিগত বাড়িতে চলছে। আবার ৬০০টিরও বেশি এমন কেন্দ্র আছে, যাদের তা-ও নেই। হয় গাছতলায়, নয়তো ফাঁকা জমিতে ক্লাস চলে।
|
প্রশাসনের কতার্দের দাবি, মূলত জমি না পাওয়ার জন্যই ওই কেন্দ্রগুলির নিজস্ব ভবন গড়ে তোলা যায়নি। সুসংহত শিশুবিকাশ প্রকল্পের জেলা আধিকারিক হীরক বন্দোপাধ্যায় বলছেন, “ভবনের অভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রাইভেট ভবন এবং অপেক্ষাকৃত অসুবিধেজনক এমন বহু জায়গায় কেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। ল্যান্ডব্যাঙ্ক থেকে জমি পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের জন্য সরকারই জমি কিনবে, এখনও পর্যন্ত এ রকম কোনও নিয়ম তৈরি হয়নি। তাই কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের জন্য আমাদের বাসিন্দাদের উপরেই নির্ভর করতে হয়।” এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, কোনও দিনই যদি ওই সব কেন্দ্রের জন্য জমি না মেলে, তা হলে কী হবে? বছরের পর বছর কি দুর্দশার এই একই চিত্র জারি থাকবে? এর উত্তর অবশ্য জেলা প্রশাসনের কারও কাছেই নেই।
প্রশাসন সূত্রে খবর, সাঁইথিয়া ব্লকে ৪০৩টির মধ্যে ২৭১টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেরই নিজস্ব ভবন নেই। তাদের মধ্যে ৬৩টি কেন্দ্র চলছে প্রাথমিক স্কুলে। ৫৭টি কোনও ব্যক্তিগত বাড়িতে। ১৫১টির ভাগ্যে আবার দু’টির কোনওটিই জোটেনি। গাছের তলায় কিংবা খোলা আকাশের নীচেই চলছে ওই সব কেন্দ্রের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। ব্লকের প্রকল্প আধিকারিকের দাবি, জমি না মেলার জন্যই এতগুলো কেন্দ্রে এখনও পর্যন্ত কোনও নিজস্ব ভবন তৈরি করা যায়নি। নানুর, মহম্মদবাজার, রামপুরহাট ২ এই সব ব্লকের চিত্রও খুব একটা আলাদা নয়। রামপুরহাট ২ ব্লকের প্রকল্প আধিকারিক শান্তি বাগদি বলছেন, “এটা ঘটনা যে জমি না মেলার জন্য খোলা আকাশের নীচে বেশ কিছু কেন্দ্র চালু আছে। এলাকার মানুষকে স্বেচ্ছায় জায়গা দেওয়ার জন্য নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টাও হয়েছে। কিন্ত তাঁদের কাছ থেকে সাড়া মিলছে না।” ওই ব্লকে এ বছরই ৩৯টি কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন তৈরির অনুমোদন মিলেছে। আবার নানুর ব্লকের প্রকল্প আধিকারিক শৈলেন রায় জানিয়েছেন, ব্লক থেকে কয়েকটি কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছে। এমএসডিপি, বিআরজিএফ প্রকল্পের টাকায় ভবন তৈরির পরিকল্পনাও নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জমিই যদি না পাওয়া যায়, ওই সব ভবন যে আদৌ তৈরি করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
অথচ এ ভাবেই বছরের পর বছর জোড়াতালি দিয়ে কর্মী-সহায়িকারা ওই সব কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছেন। প্রশাসনের কর্তারাই মেনে নিচ্ছেন, তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ওই সব ছাদহীন কেন্দ্রগুলিতে ছেলেমেয়েগুলোর দায়িত্ব ঠিক ভাবেই পালন করেন। অনেকে নিজের চেষ্টায় ছাদের ব্যবস্থাও করেছেন। মাড়গ্রামের ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী আকরুমা বেগমের অভিজ্ঞতা, “এলাকায় কেউ জমি দেননি। ভবন তৈরি না হওয়ায় কেন্দ্র চালু করতে হয়েছে রাস্তার ধারেই। রোদই হোক কিংবা বৃষ্টি, সব কিছু পার করে গত ৭ বছর ধরে সব ক’টা দিন কেন্দ্র চালু রেখেছি।” এ দিকে, ভবন না হওয়ায় নিজের মাটির বাড়িতেই গত ১৪ বছর ধরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চালাচ্ছেন একই গ্রামের ইয়াসমিন বানু। ওই কর্মীর বক্তব্য, “গ্রামের অনেক লোককে বুঝিয়েছি। কিন্তু কেউ-ই জমি দিতে চাননি। এখানে তেমন খাস জমিও নেই। ভবন না থাকায় বিশেষ করে বর্ষাকালে কেন্দ্র চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।” অভিভাবক রহিমা বিবির চার বছরের নাতনি মাড়গ্রামের ইনতলার কেন্দ্রটিতে পড়তে যায়। তাঁর চিন্তা, “ওই কেন্দ্রটি পাকা রাস্তার পাশেই। দিদিমণির নজর এড়িয়ে ওই ছোটছোট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় গিয়ে উঠতেই পারে। তাই সব সময় উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকি।” রামপুরহাটের সুন্ডিপুরে আবার এক অভিভাবকেরই বাড়ির ভাঙা বারান্দায় চলে কেন্দ্র। সওকত শেখ নামে ওই অভিভাবক বলেন, “এটা তো জোড়াতালির সংসার। সরকারের উচিত এই নিয়ে কিছু একটা ভাবা উচিত।”
এ দিকে, কেন্দ্রগুলির এমন বেহাল চিত্রের কথা মানতেই চাননি জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা। তাঁর দাবি, “আপনাদের তথ্য ঠিক নয়। নিজস্ব ভবন নেই, এমন কেন্দ্রের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। ইতিমধ্যেই আমরা বহু জায়গায় ভবন তৈরির কাজ শুরু করেছি। যেখানে নেই, সেখানেও করব।” সমস্যা সম্বন্ধে ওয়াকিবহল সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে তিনি একটি বৈঠক করেছেন। বিকাশবাবু বলেন, “বৈঠকে এই জেলায় কোথায়, কী ভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলছে, কোথায় কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন নেই এ সব নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রগুলির নিজস্ব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে জমি নিয়ে যেখানে সমস্যা আছে, সে ব্যাপারে ভূমি আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা খাস জমিতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ভবন তৈরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেখানে জমি পাওয়া যাবে না, সেখানে বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে গিয়ে জমিদানের জন্য অনুরোধ করব।” |