|
|
|
|
|
|
|
কমোডিটি মার্কেট |
ফাঁদে পা দেবেন না
অন্যের পাতা ফাঁদে পা অথবা নিজের সামান্য ভুল— দু’ক্ষেত্রেই ক্ষতি আপনার।
লেনদেনের সময়ে তাই বাড়তি সতর্ক থাকছেন তো? লিখছেন
অরিন্দম সাহা |
|
আগাম লেনদেনের বাজারে লগ্নির সময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা চুক্তির পরিমাণ, লেনদেনের অঙ্ক, লাভ-ক্ষতির হিসাব নিয়েই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু সময় বুঝে লগ্নি করলেও সামান্য অসতর্ক হলে লোকসানের অঙ্ক আকাশছোঁয়া হতে পারে। আবার কোনও লগ্নিকারীর চালাকি অথবা বেআইনি লেনদেনের ফলও ভুগতে হতে পারে আপনাকে। আজ আমরা প্রথমে আলোচনা করব লগ্নিকারীরা নিজেদের মুনাফা বাড়াতে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করেন, সে বিষয়ে।
কম সময়ে মুনাফা: ধরা যাক সোনার দাম ভবিষ্যতে পড়বে ধরে নিয়ে কোনও লগ্নিকারী তা বিক্রি করতে শুরু করলেন। সাধারণ ভাবে তিনি হয়তো ঠিক কাজই করেছেন। কিন্তু একই সময়ে অন্য এক লগ্নিকারী সোনা কিনতে শুরু করলেন। যার ফলে তার দামও বাড়তে শুরু করল। এ ভাবে বাজারে কিছুটা ভারসা ফিরল। কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হল না।
এ বার প্রথম লগ্নিকারী দেখলেন, সোনা কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভাল সুযোগ। তিনি তাই করলেন। এ দিকে, নতুন লগ্নিকারীরাও বাজারে পা রাখলেন। আর এ সবের জেরে দাম আরও বাড়ল। তখন সেই দ্বিতীয় লগ্নিকারী নিজের সোনা বিক্রি করে অন্যদের থেকে অনেকটা বেশি মুনাফা কামালেন। এই ভাবে লেনদেন করাকে ‘শর্ট স্কুইজ’ বলে।
একের ক্ষতি, অন্যের লাভ: এই ধরনের লেনদেন সাধারণত কমোডিটি মার্কেটেই দেখা যায়। ধরা যাক, রুপোর দাম এখন কেজিতে ৪০ হাজার টাকার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে এবং তা ঊর্ধ্বমুখী। সাম্প্রতিক ইতিহাসেও এর দাম ৩৮ হাজারের নীচে যায়নি। ফলে লগ্নিকারীরা ৪০ হাজারে রুপো কিনলেন ও বিক্রির জন্য ৩৮ হাজারকে ‘স্টপ লস’ হিসেবে চিহ্নিত করলেন। অর্থাৎ ততটা ক্ষতি স্বীকার করতে তাঁরা রাজি।
কিন্তু এরই মধ্যে কোনও বিচক্ষণ লগ্নিকারী নিজের কাছে থাকা রুপো বিক্রি করতে শুরু করলেন। ফলে বাজারে তার জোগান বাড়ল ও দাম আরও কমতে থাকল। এর জেরে যাঁদের ৩৮ হাজারে স্টপ লস দেওয়া ছিল, তাঁরা ক্ষতির মুখে পড়লেন। এ বার সেই বিচক্ষণ লগ্নিকারী আবার রুপো কেনা শুরু করলেন। ফলে যে-সব লগ্নিকারী কেনার জন্য চুক্তি করেছিলেন এবং ৪২ হাজারে ‘স্টপ লস’ দিয়েছিলেন, রুপোর দাম সেই সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় তাঁরাও ক্ষতির মুখে পড়লেন। এই ধরনের লেনদেনকে ‘রানিং দ্য স্টপ্স’ বলে।
এই সমস্যা এড়াতে সাধারণত বলা হয় কোনও ‘স্টপ লস’ না-দিতে। অথবা দিলেও তা বাজার চলতি ‘স্টপ লস’-এর কাছাকাছি না-রাখতে। তবে তার জন্য প্রতি মুহূর্তে বাজারের ওঠা-পড়া ইত্যাদির দিতে নজর রাখতে হবে। তা না-পারলে ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে লগ্নিকারী এই বাজারে একেবারে নতুন হলে তাঁকে ‘স্টপ লস’ দেওয়ারই পরামর্শ দেব। কিন্তু তা-ও যেন চলতি ‘স্টপ লস’-এর কাছাকাছি না-হয়।
লগ্নিকারীরা নিজেদের ভুলেও অনেক সময়ে ক্ষতির মুখে পড়েন। আসুন তারই কিছু উদাহরণ দেখি—
ভুল বরাত: ধরে নিন আপনি ১০ লট সোনা কিনতে পণ্য বাজারে চুক্তি করতে চান। কিন্তু অর্ডার দেওয়ার সময়ে সতর্ক না-থাকায় ১০-এর জায়গায় ভুল করে ১০০ দিয়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ ৯০ লট বেশি চুক্তি করেছেন। এ বার সোনার দাম ১ টাকা বাড়লে বা কমলে পণ্য বাজারে আপনার ১০০ টাকা লাভ বা ক্ষতি হবে। ধরে নিলাম এ ক্ষেত্রে দাম ১০০ টাকা কমেছে। ফলে লগ্নিকারীর ক্ষতি হবে (১০০ x ১০০ x ৯০)= ৯ লক্ষ টাকা। কিন্তু যদি ভুল না-করতেন, তা হলে ক্ষতি হত ১ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ সামান্য একটা শূন্যের ভুলে ক্ষতির অঙ্ক প্রায় ৮ লক্ষ বেড়ে গিয়েছে। এই ধরনের ভুলকে বলে ‘ফ্যাট ফিঙ্গার এরর’। |
|
নষ্ট সুযোগ: পণ্য বাজারে যখন খুব বেশি ওঠা-নামা চলে, তখন এই ধরনের লেনদেন দেখা যায়। কোনও লগ্নিকারী কম্পিউটরের মাধ্যমে বাজার দরে অর্থাৎ মার্কেট অর্ডারে (ধরা যাক ৬,০০০ টাকা প্রতি ব্যারেল অশোধিত তেল) পণ্য কিনতে বা বেচতে চুক্তি করলেন। কিন্তু তাঁর অর্ডার পণ্য বাজারের এক্সচেঞ্জের সার্ভারে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখা গেল দাম বেড়ে ৬,২০০ টাকা হয়েছে। তখন কিন্তু লগ্নিকারীকে ওই বেশি দামেই পণ্য কিনতে হয়। এই ধরনের লেনদেনকে ‘স্লিপেজ’ বলা হয়। এ জন্য উচিত ‘ইমিডিয়েট অর ক্যানসেল’ অর্ডার দেওয়া। যেখানে সার্ভারে পৌছনোর সময়ে পণ্যের দাম লগ্নিকারীর ঠিক করে দেওয়া দরের সঙ্গে না-মিললে অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে।
ভাল সুযোগের অপেক্ষায়: অনেক সময়ে দাম বাড়বে ধরে নিয়ে আগাম লেনদেনের বাজারে পণ্য হাতে রেখে দেন লগ্নিকারী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না -হলে, তাঁদের বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এই ভাবে লগ্নি করাকে ‘বটম ফিশিং’ বলে। যা বেশ ঝুঁকির।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর আগে অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে আলুর দাম বাড়বে ধরে নিয়ে কিছু লগ্নিকারী পণ্য হাতে রেখে দেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন যে, তার পর হিমঘর খালি করার সময়। তখন আলুর দাম বাড়বে তো না-ই, বরং আরও কমতে পারে। পণ্য হাতে রেখে দেওয়ায় তখন ওই লগ্নিকারীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল।
স্বল্প মেয়াদের উত্থান: অনেক সময়েই দীর্ঘদিন ধরে চলা খরা কাটিয়ে হঠাৎ স্বল্প মেয়াদে কোনও পণ্যের বাজার ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার জেরে তা ফের পড়ে যায়। তখন ওই স্বল্প মেয়াদের উত্থানকে ‘ডেড ক্যাট বাউন্স’ বলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাম অনেক পড়ে গিয়েছে ধরে নিয়ে লগ্নিকারীরা ক্ষতি এড়াতে পণ্য বেচে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে থাকেন অথবা নতুন লগ্নিকারী পণ্য বাজারে পা রাখেন, তখন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
এ বার কথা বলব বিভিন্ন বেআইনি লেনদেন নিয়ে—
আঁতাত: বেআইনি ভাবে পণ্য লেনদেনের একটি উদাহরণ ‘পেন্টিং দ্য টেপ’। এই পদ্ধতিতে লগ্নিকারীরা বোঝাপড়া করে নিজেদের মধ্যে পণ্য লেনদেন করতে থাকেন। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, স্বাভাবিক ভাবেই বাজারে লেনদেন হচ্ছে। এ ভাবে কেনা-বেচা করে তাঁরা সেই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
দৌড়ে প্রথম: ধরে নিচ্ছি কোনও লগ্নিকারী একবারে অনেক বেশি পণ্য কেনার চুক্তি করতে চান। তিনি যে- সদস্য ব্রোকারের মাধ্যমে লগ্নি করবেন, সেই ব্রোকার সে কথা শুনে আগে থেকেই নিজের জন্য অর্ডার দিয়ে রাখলেন। অর্থাৎ সদস্যের যেখানে উচিত ছিল আগে লগ্নিকারীকে সাহায্য করা, সেখানেই তিনি নিজের মুনাফার দিকে নজর দিয়েছেন। এই লেনদেনকে ‘ফ্রন্ট রানিং’ বলে। যা অনৈতিক লেনদেনের উদাহরণ। এ জন্য বলা হয় বড় অর্ডারের ক্ষেত্রে এক জন সদস্যকেই অর্ডার না-দিয়ে, তা বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে ভাগ করে দিতে। |
লেখক পণ্য বাজার বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|