এখনই রোগীর জরুরি অপারেশন করাতে হবে। একলপ্তে লক্ষাধিক টাকা দরকার। কিন্তু হাতে যে টাকা নেই!
তাতে চিকিৎসা আটকাবে না। হাসপাতালে ভর্তির সময়ে কিছু জমা রাখলে অস্ত্রোপচার হয়ে যাবে। বাকি খরচ মেটানো যাবে দু’-তিন বছর ধরে, মাসে মাসে টাকা দিয়ে।
টিভি-ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিনের মালিক হতে সমান মাসিক কিস্তি (ইকোয়েটেড মান্থলি ইনস্টলমেন্ট, সংক্ষেপে ইএমআই)-র চল ছিলই। এই তালিকায় সংযোজন চিকিৎসার সুযোগ। রাজ্যের নানা প্রান্তে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে তা চালু হয়েছে। আপাতত শুধুমাত্র ব্যয়সাধ্য অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে। অবশ্য নতুন ব্যবস্থার প্রশংসার পাশাপাশি, সমালোচনাও শোনা যাচ্ছে।
কিস্তিতে বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনলে ঋণ শোধ না-হওয়া ইস্তক দলিল ব্যাঙ্কের কাছে জমা রাখতে হয়। ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনতে হলে ব্যাঙ্ককে প্রতি মাসের জন্য আগাম ‘পোস্ট-ডেটেড চেক’ দিয়ে রাখতে হয়, যা বাউন্স হওয়া মানে অপরাধ। চিকিৎসার বকেয়া খরচ হাসপাতাল আদায় করছে ঠিক কী ভাবে?
সব হাসপাতাল এক নিয়ম অনুসরণ করছে না। যেমন, কলকাতায় ইএম বাইপাসের ও মুকুন্দপুরের দুই হাসপাতালের কর্তাদের দাবি, মূলত ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তিতে তাঁরা কিস্তির চুক্তি করছেন রোগীর পরিবারের সঙ্গে। কখনও কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হচ্ছে, কখনও তা-ও নয়। বাইপাসের হাসপাতালটির প্রধান তাপস মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য: অনেক রোগীর স্বাস্থ্য-বিমা (মেডিক্লেম) থাকে না। তাঁদের অনেকের পক্ষে এককালীন বেশি টাকা বার করা মুশকিল। কিস্তির ব্যবস্থায় ওঁদের বড় উপকার হচ্ছে। “হয়তো অপারেশন টেবিলে দেখা গেল, বাড়তি স্টেন্ট বা ভাল্ভ বসাতে হবে। বড় খরচ। ইএমআইয়ে চিন্তা কমে,” বলছেন তিনি।
তাপসবাবুদের হাসপাতাল হার্টের রোগের অস্ত্রোপচারে কিস্তির সুবিধে পেতে হলে অবশ্য এক জন সরকারি কর্মীকে ‘গ্যারান্টার’ হতে হবে। অস্ত্রোপচারের খরচের ৬০-৭০% আগে মিটিয়ে দিতে হয়। বাকিটা দু’বছরের কিস্তিতে। অন্য দিকে, পাঁচটি নামী ব্যাঙ্কের যে কোনও একটির ক্রেডিট কার্ড যাঁরা ব্যবহার করেন, আলিপুরের এক হাসপাতালে ইএমআইয়ে অস্ত্রোপচারের সুযোগ শুধু তাঁদের জন্য। সংস্থার প্রধান রূপক বড়ুয়া জানিয়েছেন, ক্রেডিট কার্ডে খরচের ঊর্ধ্বসীমা যত, ততটাই বাকি রাখা যাবে। বকেয়া শুধতে হবে এক বছরের মধ্যে।
দুর্গাপুরের এক হাসপাতাল ‘পোস্ট ডেটেড চেক’ নিয়ে রাখছে। হাসপাতালটির প্রধান, হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ সত্যজিৎ বসু জানিয়েছেন, তাঁরা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, পেসমেকার বসানো ও ভাল্ভ-প্রতিস্থাপনে ইএমআই চালু করেছেন। খরচের ১৫% আগাম, বাকিটা কিস্তিতে। “চেক বাউন্স করলে ফৌজদারি মামলা করা যায়, এটা আমাদের সুরক্ষা,” মন্তব্য সত্যজিৎবাবুর।
এ হেন কোনও ‘নিরাপত্তা’ ছাড়া, নিছক বিশ্বাসের ভরসায় কিস্তির সুযোগ দেওয়াটা কি ঝুঁকি নয়? চুক্তির খেলাপও তো হতে পারে! তাপসবাবু বলেন, “হতেই পারে। তবে ঘটনা হল, গত তিন বছরে এখানে শ’সাতেক রোগী ইএমআইয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন, এবং কেউ টাকা ফাঁকি দেননি।” মুকুন্দপুরের হাসপাতালটির কর্ণধার অলক রায়েরও দাবি, গত তিন বছরে এই ব্যবস্থায় তাঁরা ধোঁকা খাননি।
রোগী ও বেসরকারি হাসপাতাল-কর্তাদের একাংশের গলায় অবশ্য অন্য সুর। তাঁদের যুক্তি: কিস্তিতে যা কিছুই কেনা হোক না কেন, আখেরে গুণতে হয় অনেক বেশি টাকা। চিকিৎসাও ব্যতিক্রম নয়। বস্তুত ইএমআই দিয়ে নামীদামী হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ মধ্য ও নিম্নবিত্তের ঘাড়ে চাপানোর নতুন কৌশল হিসেবেই দেখছেন এঁরা। যেমন কসবার এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার স্বরাজব্রত পুরকায়স্থের মতে, “যাঁরা কিস্তিতে টাকা নিচ্ছে, তারা আসলে নিজেদের লাভের জায়গাটা ঠিক রাখতে অপারেশনের রেট আগেই বাড়িয়ে রাখছে।” টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা ও ‘কিস্তির চিকিৎসা’র মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, “যাঁরা একবারে টাকা দিতে পারছেন না, তাঁরা কিস্তিতেও দেবেন না।” আবার সল্টলেক লাগোয়া বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা রূপালি বসুর মতে, কিস্তি মানেই পরিষেবা-মানের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে আপস করা। “আমাদের হাসপাতালে অপারেশনের আগে ডাক্তারবাবুরা রোগীপক্ষের সঙ্গে বসে টাকার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নেন। ফলে খরচ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি বা বিল মেটাতে না-পারার ঝামেলা থাকে না,” দাবি তাঁর।
উত্তরে কিস্তিপন্থীরা তুলে আনছেন ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’র কথা। অর্থাৎ, ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক কর্তব্য পালনের দায়িত্ব। ওঁদের বক্তব্য: সরকারি হাসপাতালে খরম কম, কিন্তু অপারেশনের ‘ডেট’ পাওয়াই সমস্যা। আবার বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন তাড়াতাড়ি হতে পারে, কিন্তু সেখানকার খরচ জোগানোর সাধ্য অনেক পরিবারের থাকে না। এ সব ক্ষেত্রে কিস্তিতে টাকা মেটানোর সুযোগ পেলে বহু লোক উপকার হবে। তাই এটা একটা সামাজিক কাজ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরা। ওঁদের আরও যুক্তি: বিল ‘বেশি’ হওয়ার অজুহাতে হাসপাতালের পাওনা না-মেটানোর প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষত রোগীর মৃত্যু হলে অনেক সময়েই পরিষেবার দাম মিলছে না। ইএমআই এর কিছুটা সুরাহা করবে। “ইএমআইয়ের দৌলতে বহু নিম্ন আয়ের পরিবারও এখন গাড়ি-ফ্ল্যাট কিনছে। চিকিৎসাই বা বাদ থাকবে কেন?” প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা।
সরকারি হাসপাতালেও কি এমন কিছু হতে পারে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর জবাব, “এখনও তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। তবে রোগী একেবারে টাকা দিতে না-পারলে হাসপাতালই অনেক সময়ে বকেয়া মকুব করে দেয়।” |