মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার মঞ্চের সামনে বাঁশের ব্যারিকেডের ভিতরে দাঁড়িয়েছিলেন প্রৌঢ়া খাদি বিবি। হাতে একটি চিঠি। এক মহিলা কনস্টেবলকে বারবার অনুরোধ করছিলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর হাতে আমার চিঠিটা একটু দিয়ে দেবে মা! খুব দরকার।”
মাস খানেক আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন তাঁর মেয়ে মার্জিয়া বিবি। জামাই ফের বিয়ে করেছে। নাকাশিপাড়া থানার পুলিশের কাছে জানিয়েও কিছু হয়নি বলে অভিযোগ। অন্য উপায় না দেখে খাদি বিবি ঠিক করেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়েই সুবিচার চাইবেন। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী মার্জিনাকে দিয়ে চিঠিটি লিখিয়েছেন। সেই চিঠি হাতে নিয়ে সাতসকালে চন্দননগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বাসে করে সোজা পলাশির জনসভার মাঠ। সকাল থেকেই মঞ্চের সামনে ব্যারিকেডের সামনে ঠায় বসেছিলেন। সভা চলাকালীন তিনি ব্যারিকেডের ফাঁক গলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আগেই তাঁকে ধরে ফেলেন ওই মহিলা কনস্টবল। হাজার কাকুতিমিনতি করেও মঞ্চের দিকে যেতে পারেননি। বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে লাল খামে ভরে চিঠিটি তুলে দিতে বাধ্য হলেন। বিষয়টি জানার পরে জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচী রমণ মিশ্র অবশ্য বলেন, “ওই মহিলা যদি অভিযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে গ্রাম-গঞ্জ থেকে এমন বহু মানুষ এসেছিলেন নানা প্রত্যাশা নিয়ে। মঞ্চের একেবারে ডান দিকে ভিড়ের ভিতরে দাঁড়িয়েছিলেন কালীগঞ্জের মির্জাপুরের বাসিন্দা বছর সাতাশের ফরিদা খাতুন। |
মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ওঠার পরে তিনিও ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারলেন না। ‘দিদি’র দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ভিড়ের ভিতর থেকে বারবার হাত নাড়ছিলেন। তাতেও লাভ না হওয়ায় এক সময় ফরিদা চিৎকার করে বলতে থাকেন, “আমার দাদু বার্ধক্য ভাতা পাচ্ছেন না। দিদি একটু ব্যবস্থা করুন।” হতাশ ফরিদা বলেন, “দাদুর বয়স ৮০। বিপিএল তালিকায় নাম থাকলেও ভাতা পান না। সংসারে খুব অভাব।”
ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন কালীগঞ্জের গোবিন্দপুরের বাসিন্দা বছর ষাটেকের হানিফা বেওয়াও। ১৯ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গিয়েছেন। কোনওমতে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ে করে ছেলে আলাদা থাকেন। বারান্দায় কোনও রকমে মাথা গুঁজে রাতটুকু কাটিয়ে দেন। তিনি বলেন, “এলাকার নেতাদের বারবার বলেও কোনও সাহায্য পাইনি। একশো দিনের কাজও পাইনি। কোনও ভাতাও পাইনি। একটা সরকারি ঘর দিল না। তাই আজ সভায় এসেছিলাম।” তাঁর বিশ্বাস, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে পারলে নিশ্চয়ই একটা হিল্লে হত।”
একই ভাবে হতাশ মির্জাপুরেরই বাসিন্দা নাফিসা মুন্সি। নাফিসার স্বামী আজিজুল মুন্সি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিন ছেলে স্কুলে পড়ে। দিনরাত বিড়ি বাঁধেন নাফিসা। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যদি একটু আমাদের দেখতেন, তাহলে আমার ছেলেরা হয়তো একদিন পড়াশোনা করে অনেক বড় হতে পারত।”
নাকাশিপাড়ার বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি কল্লোল খাঁ বলেন, “আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যেহেতু মাটির কাছাকাছি থাকেন, তাই সকলেই তাঁকে নিজের লোক বলে মনে করেন। সকলেই চান তাঁর কাছাকাছি পৌঁছতে। সমস্যার কথা জানাতে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে সবসময় সে আশা পূরণ হয় না।” তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যখন জেলা সফরে আসেন, তখন অনেকেই আমাদের কাছে আসেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আমরা চেষ্টা করি নিজেরাই সমস্যা সমাধানের জন্য।” |