অত্যাচারিতা মেয়ের নাম প্রকাশ করা বারণ। খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা যদি নিজেরাই বলেন,
‘আমি তো অপরাধী নই,
কেন আমি লুকিয়ে থাকব?’ সমস্যা মেটে না, আরও জটিল হয়।
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। |
একটি ধর্ষণ একটি মেয়ের কাছ থেকে অনায়াসে তাঁর আত্মপরিচয় এবং পরিবারদত্ত নাম ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কতকগুলো অমানুষ কোনও মহিলার শরীরের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করলে মুহূর্তে নিজস্ব নাম পিছনে ফেলে তিনি নির্ভয়া, অপরাজিতা, গুড়িয়া বা পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষিতা-র পরিচয়ে পরিচিত হয়ে যান। এটাই এখনও পর্যন্ত সামাজিক দস্তুর এবং দেশের আইন। কিন্তু যখন কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষিতা প্রতীকী নাম সরিয়ে স্ব-ইচ্ছায় নিজের নাম প্রকাশ করতে চান, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা তখন কী হবে? তারা কি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে মঞ্চটা এগিয়ে দেবে? না কি, সেই সিদ্ধান্তের পরবর্তী ঝড়ঝাপটা সম্পর্কে ধর্ষিতাকে সচেতন করে দেওয়াটা তার কর্তব্য? মিডিয়ার পাশাপাশি কী অবস্থান নেবে পুলিশ বা ধর্ষিতাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি? |
প্রশ্নগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অতি সম্প্রতি দিল্লির দ্বারকার সেক্টর ১৯-এর এক তিন কামরার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা প্রৌঢ়-র সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে। দিন কয়েক পরেই ১৬ ডিসেম্বর। ঠিক এক বছর আগে ওই দিনই দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাসে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন তাঁর ২৩ বছরের আদরের মেয়ে। ধর্ষকেরা এতটাই অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছিল যে, চিকিত্সকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ২৯ ডিসেম্বর মারা যান ‘নির্ভয়া।’
নির্ভয়া, দামিনী, বিজলি, অমানত, দিল্লির ধর্ষিতা অনেক নামেই ডাকা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু মেয়ের বাবা, সেই প্রবীণ মানুষটি চান, তাঁর মেয়েকে ও তাঁদের পরিবারের প্রত্যেককে চিনুক সকলে। মুখ লুকনো নয়, টেলিভিশনে চেহারা অস্পষ্ট করে দেওয়া নয়। তাঁর যুক্তি, “আমার মেয়ে অপরাধী নয়। তার উপর যারা অত্যাচার চালিয়েছে, মুখ লুকোক সেই কাপুরুষ বদমায়েশরা। আমি চাই, আমার মেয়ের আসল নাম সবাই জানুক।”
এই ঘটনার ক্ষেত্রে মেয়েটির বাবার আর্জি মেনে নিতে মিডিয়ার হয়তো বিশেষ সমস্যা হবে না, কারণ মেয়েটি আর জীবিত নেই। কিন্তু ধর্ষিতা যদি বেঁচে থাকেন এবং পরিচয় প্রকাশের দাবি জানান? মেনে নেওয়া হবে সেই দাবি? যদি তার পরিণামে সমস্যা দেখা দেয়? হয়তো আসল পরিচয় প্রকাশের পরবর্তী সামাজিক-মানসিক চাপের বহর পুরোপুরি আন্দাজ বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি সেই মেয়ে। আবেগে, ঝোঁকের মাথায় না-বুঝে হ্যাঁ বলে দিয়েছেন। পরিচয় প্রকাশের পর গুজগুজ, ফিসফাস, আঙুল তোলা, আলগা মন্তব্য। পরিচিত-বন্ধুরা অনেকে এড়াতে শুরু করেছে। বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়তে বলছেন, মেয়ে বা বোনের স্কুলে সমস্যা হচ্ছে, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। ইত্যাদি-ইত্যাদি। মেয়েটি তখন আবার নামহীন হতে চাইতে পারে। কিন্তু তখন আর ফেরার পথ নেই।
প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করা মেয়েদের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর অভিজ্ঞতায়, এই মেয়েদের অধিকাংশই পরবর্তী কালে সংসার করতে চান।
তাঁদের কেউ-কেউ নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে আগের জীবনের কথা না-লুকিয়ে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন। তাতে ফল হয় উল্টো। পরবর্তী কালে যখন স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যে ঝগড়া বা সমস্যা হয় তখন অবধারিত ভাবে স্বামীটি সেই দুর্বল জায়গায় মোক্ষম অস্ত্র হানেন, “দশ হাতে ঘেঁটে আসা মাল, তোর আবার অত কথা কীসের রে?” তখন মেয়েটি আফশোস করেন, নিজের সত্যবাদিতাকে বোকামি বলে বুঝতে পেরে আজীবন দগ্ধ হন। বৈতালি বলেন, “এই জন্য আমি কখনও এই রকম কোনও মেয়েকে পরিচয় বা আগের জীবন সম্পর্কে সব কিছু জানাতে উত্সাহ দিই না। আমাদের সমাজ এখনও সেটা নিতে পারার মতো সাবালক হয়নি।” ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা রুচিরা গোস্বামী বিষয়টাকে একটু ভিন্ন কোণ থেকে দেখতে চান। তাঁর মত: ধর্ষিতা নিজের নাম জানাতে চাইতে পারেন, মিডিয়া তা প্রকাশও করতে পারে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কারও তাড়াহুড়ো করা চলবে না। আগে ধর্ষিতার পর্যাপ্ত ও যথাযথ কাউন্সেলিং করতে হবে। পরিচয় প্রকাশিত হলে কোন কোন চড়াই-উতরাই পার করতে হতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁকে সম্যক ধারণা দিতে হবে, যাতে পরবর্তী কালে তিনি বলতে না পারেন যে, ‘আমি এতটা না বুঝে বলে ফেলেছি,’ বা ‘অমুক আমাকে ভুল বুঝিয়ে ছবি-নাম প্রকাশ করে দিয়েছে।’ ধর্ষিতার লিখিত সম্মতি নিয়ে রাখতে হবে। অর্থাত্, কোনও পক্ষের কোনও আত্মগ্লানি, কোনও ভুল বোঝাবুঝির জায়গা যেন না থাকে।
সি আই ডি (পশ্চিমবঙ্গ)-র ‘অ্যান্টি হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ইউনিট’-এর দায়িত্বে রয়েছেন শর্বরী ভট্টাচার্য। তাঁর যুক্তি অন্য। কেউ ধর্ষিতা হলেন বা পাচার হয়ে যৌনপল্লিতে ছ’মাস কাটিয়ে এলেন, তখন এমনিতেই কিছু পাড়ার লোক, আত্মীয়বন্ধু, পরিচিত লোক জানবেন। ফলে ‘স্টিগমা’ থাকবেই। এখন, সেই মেয়েটির সম্মতিতে সংবাদমাধ্যমে তাঁর আসল পরিচয় আরও ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি যদি মনে করেন, নাম প্রকাশের সিদ্ধান্তে তাঁর বেঁচে থাকার যন্ত্রণা বাড়ল, তখন অপরাধের দায় সংবাদমাধ্যম এড়াতে পারবে না।
আর একটা দিকও দেখছেন শর্বরীদেবী। যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়ে বা কোনও ধর্ষিতা চাইলেন যে, সংবাদমাধ্যমে তাঁর আসল ছবি আর নাম প্রকাশিত হোক। কিন্তু ওই মেয়েটিকেই হয়তো পাচারকারীরা আবার পাকড়াও করে কোনও ভাবে পাচার করতে চাইছে, বা ধর্ষণকারীর অধরা সঙ্গীরা কোনও ভাবে সেই ধর্ষিতাকে খতম করতে চাইছে, যাতে তিনি সাক্ষ্য দিতে না পারেন। সে ক্ষেত্রে তো পরিচয় প্রকাশ হলে মেয়েটির ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
১১ ডিসেম্বর সন্ধেবেলা ম্যাক্সমুলার ভবনে দেখানো হল উদয়ন নাম্বুদিরি-র পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘দ্য গার্ল হু লস্ট হার নেম।’ তথ্যচিত্রের বিষয়: ধর্ষিতার নাম প্রকাশের ঔচিত্য নিয়ে বিতর্ক। উদয়ন নিজে দীর্ঘ দিনের সংবাদকর্মী। প্রশ্ন করেছিলাম, ধর্ষিতার সম্মতিতেই সংবাদমাধ্যম হয়তো তাঁর নাম প্রকাশ করল, তার পর তাঁর জীবনে যে বাড়তি ঝড় আসবে তা সামলাতে মিডিয়া কি তাঁর পাশে থাকবে? যদি না থাকে তা হলে এই পরিচয় প্রকাশের প্রক্রিয়ায় শরিক হওয়া কি মিডিয়ার সাজে? উদয়ন পাল্টা বললেন, “সমাজ পাল্টাতে চাইলে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চাইলে ব্যতিক্রমী কিছু মেয়ের ইচ্ছায় মিডিয়াকে শরিক হতে হবে বইকী।”
কয়েক বছর আগে ঘাটশিলায় বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়া এক তরুণী নিজের পরিচয়ে সংবাদপত্রে লিখেছিলেন। স্বপরিচয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাওয়ার কথা টেলিফোনে বলছিলেন পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষিতাও। তিনি ইতিমধ্যেই টেলিভিশন চ্যানেলে মুখ দেখিয়েছেন, পরিচিত হয়েছেন নিজের নামে। তিনি বলছিলেন, “আমি টেলিভিশনে পরিচয় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম হঠাত্ই। তার জন্য কোনও আফশোস নেই। বরং মিডিয়ায় সব খোলাখুলি বলার পর হেনস্তা কমেছে। ফিসফিস আলোচনা, কৌতূহল অনেক কমেছে। আমার মেয়ের স্কুলে গেলে ওর বন্ধুরা এখন আমাকে ঘিরে বলে, ‘হোয়াট আ ব্রেভ লেডি ইউ আর, আন্টি! উই আর প্রাউড অব ইউ।’ আত্মপরিচয় নিয়ে বাঁচার ব্যাপারে আমি যদি ধর্ষিতাদের ১ শতাংশর কাছেও দৃষ্টান্ত হতে পারি, তা হলে মনে করব জীবন সার্থক হল।”
তবু, নারীর ‘সতীত্ব’ নিয়ে এখনও বিলক্ষণ মাথা-ঘামানো সমাজে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন ব্রেকিং নিউজের পিছনে দৌড়তে থাকা সংবাদমাধ্যম ধর্ষিতার সম্মতি পেলেও তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশের গুরুদায়িত্ব কতটা পরিণতির সঙ্গে পালন করতে পারবে, সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। |