উন্নয়নের কোন পথটা ঠিক, তা নিয়ে তর্কটা কিন্তু রীতিমত জমে উঠেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল |
কথোপকথন গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি। দিলীপ ঘোষের সুচিন্তিত চিঠি (‘ঠিক বুঝলাম না’, ১২-১২) এই প্রক্রিয়াকেই সমৃদ্ধ করেছে। আমার লেখা একটি সংবাদ প্রতিবেদনের (‘ভুলে ভরা নীতিতেই ভরাডুবি কংগ্রেসের’, ৯-১২) প্রেক্ষিতে তাঁর চিঠিটি, তাই কথোপকথনের উদ্দেশ্যেই দু’একটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, আমার লেখাটি একটি সংবাদ প্রতিবেদন, যেখানে আমার ব্যক্তিগত মতামতের ‘দ্ব্যর্থহীন প্রকাশ’ ছিল না, তার প্রশ্নও ছিল না, এটি ছিল মূলত কংগ্রেস নেতৃত্ব ও দিল্লির রাজনীতির কারবারিদের অভিমতের ভিত্তিতে তৈরি। দ্বিতীয়ত, লেখার কোথাও অমর্ত্য সেনকে কংগ্রেসের ‘দলীয় উপদেষ্টা’ বলা হয়নি।
তবে একটা কথা অনস্বীকার্য। গোটা দেশে, এমনকী বিদেশেও আর্থিক বৃদ্ধি বনাম বিকাশ সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিতর্ক সংবাদমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জগদীশ ভগবতী বনাম অমর্ত্য সেন বিতর্ক যে সম্পর্কে দিলীপবাবু একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি সেটি কিন্তু প্রবল ভাবে প্রচারিত একটি বিষয়। এই বিতর্ক আরও ইন্ধন পেয়েছে, যেহেতু কংগ্রেস নেতারাই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বার বার বলেন, অমর্ত্য সেনের দর্শনই তাঁদের নীতি ও আদর্শগত মস্তিষ্কস্বরূপ। কর্মসুরক্ষা নিয়ে তো প্রধানমন্ত্রী নিজেই একাধিক বার অমর্ত্য সেনকে অনুসরণ করার কথা বলেন। অন্য দিকে বিজেপির নেতারা অনেকে ভগবতীকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিজেপির মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদের মন্তব্যের কথা লিখেছিলাম। কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে তিনি বলেছেন, “অমর্ত্য সেন ও জগদীশ ভগবতী বিতর্কে বোধহয় ভগবতীর অর্থনৈতিক লাইনকে গ্রহণ করার সময় এসেছে।” |
এটি যতটা রাজনৈতিক বিতর্ক, ততটা অর্থনীতির কি না, জানি না। তবে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। অমর্ত্যবাবু মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করার পর এই মেরুকরণ বেড়েছে। যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, শীর্ষ বিজেপি নেতারাও অমর্ত্য সেনকে শ্রদ্ধা করেন। প্রসঙ্গত, অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়েই তাঁকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়। কারণ তখনই তিনি নোবেল সম্মান পান। আসলে ভগবতী বনাম অমর্ত্য সেন বিতর্কটাকে অতিসরল করে ফেললে ভুল হয়। অমর্ত্য সেন সামাজিক বিকাশ ও আমজনতার দারিদ্র দূরীকরণের চেষ্টার কথা বলেন মানে তিনি বৃদ্ধির বিরোধী, তা তো নয়। আবার জগদীশ ভগবতীও সামাজিক বিকাশের বিরোধী নন। পন্থা নিয়ে মতপার্থক্য অর্থনীতির চর্চার বিষয়, কিন্তু সমস্যা হয় প্রয়োগে এসে। রাজনৈতিক দল যা করে তাতে প্রয়োগের ব্যভিচার হয়।
প্রশাসনিক অযোগ্যতা, নীতিপঙ্গুতা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অভিজাততন্ত্রের বিচ্ছিন্নতা আসলে কোনও তত্ত্বকেই বাস্তবায়িত করতে পারে না। কার্ল মার্ক্সের নাম নিয়েও সি পি এম বহু ক্ষেত্রেই মার্ক্সবাদী পথকে অনুসরণ করে না। দিলীপ ঘোষ সুনিপুণ ভাবে অমর্ত্য সেনের যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন সেটিও কংগ্রেস অনেকাংশেই অনুসরণ করেনি। আসলে অর্থনীতির বিতর্ক আর রাজনীতির বিতর্ক দু’টি পৃথক বিষয়। কংগ্রেস রাজস্থানে বিনামূল্যে ল্যাপটপ মোবাইল বিলি করে দাবি করছে এ-সব সামাজিক প্রকল্প গরিব মানুষের স্বার্থে, এটাই অমর্ত্য সেনের মতাদর্শগত ভিত্তি, ‘আমাদের’ জন্য না, এ হল প্রান্তিক মানুষের জন্য ভর্তুকি! আসলে এই রাজনৈতিক জনসম্মোহনী নীতি যে অমর্ত্য সেন-জঁ দ্রেজের প্রেসক্রিপশন নয়, সেটা কংগ্রেস নেতাদের কে বোঝাবে? বোঝালেও কি তাঁরা বুঝবেন?
সমস্যাটা কংগ্রেস ও বিজেপির, অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজের নয়। কিন্তু অমর্ত্য সেনের নামে যে মতবাদ কংগ্রেস অনুসরণ করার দাবি করে এসেছে এত দিন, সেটি যে ঘোরতর বিতর্কের মুখে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর একটি অনুরোধ।
কংগ্রেসের আর্থিক নীতির রূপায়ণে কোথায় কোথায় অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ অখুশি, দিলীপবাবু তার কিছু আভাস দিয়েছেন। সেগুলি আরও সবিস্তারে যদি তিনি জানান, তবে আমরা আরও সমৃদ্ধ হব। |