প্রবন্ধ ১...
দুই তরফেই এই নির্বাচন মরণ-বাঁচন প্রশ্ন
ক দিক থেকে বলতে গেলে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যা হচ্ছে, সেটার অবশ্যম্ভাবিতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল চল্লিশ বছর আগে, সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। মুক্তিযুদ্ধের জয়ের পর পরই যে ভাবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ পনেরো বছর বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফৌজি শাসন অব্যাহত থাকে, তার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের ‘অপর’ পক্ষের একটা পুনর্বাসন সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালে এক নৃশংস অভ্যুত্থানে মুক্তিযুদ্ধের জনক সপরিবার নিহত হন। আর তার পর, ১৯৭৫ থেকে ’৯০ কালপর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি কেবল নতুন করে পায়ের তলায় মাটি পায় তা-ই নয়, সেই মাটি শক্তপোক্ত করারও প্রভূত সময় পায়। যুদ্ধাপরাধীরাও সগৌরবে পুনর্বাসিত হন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অধিকার ও রসদ ফিরে পান। একটু একটু করে পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ এবং ‘ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ রাজনীতি’ এই দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম ধারাটির নেতৃত্বে নানা আপস সত্ত্বেও আওয়ামি লিগ-ই থেকে যায়। আর দ্বিতীয় ধারাটির নেতৃত্বে আসীন হয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত জগাখিচুড়ি দল বিএনপি।
মরিয়া। ঢাকার রাজপথে সংঘর্ষ। ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩। ছবি: এ পি।
মৌলিক অর্থনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে এই দুটি ধারার মধ্যে অবশ্য তেমন পার্থক্য নেই। দুটি ধারাই বর্তমানে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তবে বিএনপি-র মধ্যে ভারত-বিরোধিতার মাত্রা অনেক বেশি। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে (হেফাজতে ইসলাম, ইসলামি শাসনতন্ত্র) তাদের সখ্যও অনেক বেশি। তাই অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে কাছাকাছি হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে শক্তি বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি। আরও একটি দল আছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চেতনায় (ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র) পূর্ণ মাত্রায় বিশ্বাসী বলে আওয়ামি লিগেরও বিরোধী: আওয়ামি লিগ গোত্রের মুক্তিযুদ্ধ-চেতনায় তাঁরা খণ্ডীকরণের প্রচেষ্টা দেখেন।
১৯৯০-এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে পুনরায় গণতন্ত্র হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯০-এর পর থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামি লিগ ও বিএনপি-র মধ্যে পালাক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাটা উভয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে ‘অনুগ্রহ’ বণ্টনের মাধ্যমে দলকে অটুট রাখা যায়, প্রসারিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যেই উত্‌সাহের কোনও ঘাটতি নেই। দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের মডেলে ক্ষমতা দখলের ও ক্ষমতা রক্ষার এই প্রতিযোগিতা ১৯৯০ থেকে আজ পর্যন্ত কমবেশি শান্তিপূর্ণ ধারায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে ১৯৯০ সালে বিএনপি, ১৯৯৬-এ আওয়ামি লিগ, ২০০১-এ আবার বিএনপি এবং সর্বশেষ ২০০৮-এ আওয়ামি লিগ ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। যদিও প্রতিবারই পরাজিত পক্ষটি পরাজয় স্বীকার করেনি, বরং বলতে চেষ্টা করেছে যে, নির্বাচনে কারচুপির জন্যই এই ফলাফল। তবু বলা যায়, এর পরও একটি আপেক্ষিক গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবস্থানকে প্রলম্বিত করে সেনাক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার একটি চেষ্টা নিলেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
এ বারের নির্বাচন ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুটো বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এবং শাসনতন্ত্রের সংশোধন করে এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে সেনাবাহিনী কখনওই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম না হয়। সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী। গত ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামি লিগ দল হিসেবে একক ভাবে প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। মহাজোটের অন্যতম মিত্র দল এরশাদের জাতীয় পার্টি-সহ অন্য দলগুলি পেয়েছিল আরও ৮ শতাংশ ভোট। সব মিলিয়ে আওয়ামি নেতৃত্বাধীন জোট প্রায় ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদের ৮৭ শতাংশ আসনে (২৬২টি) জয়লাভ করে। অন্য দিকে বিএনপি-র আসন ছিল মাত্র ৩২টি, যদিও ভোটের অনুপাত ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ। এক কথায় বলা যায়, নির্বাচনী নিরঙ্কুশ বিজয় আওয়ামি লিগকে এ বারই অনেক বছর পর প্রথম বারের মতো শাসনতন্ত্র সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।
তবে, গত পাঁচ বছরে বহু উন্নয়নমূলক কাজ এবং অর্জন বর্তমান সরকারের থাকলেও ’৯২-এর সংবিধানে পরিপূর্ণ ভাবে প্রত্যাবর্তন আওয়ামি লিগের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি সুশাসন ও দুর্নীতিহীন একটি ভাবমূর্তি গড়ে তোলাও। ফলে এ বারের নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে এসে আওয়ামি লিগ তার গত নির্বাচনের নিরঙ্কুশ সমর্থনকে আর ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। এরই মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসনীয় কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ যে কাজটিতে নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে আওয়ামি লিগ সরকার দুঃসাহসের সঙ্গে হাত দিয়েছে, সেটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইসলামি মৌলবাদে বিশ্বাসী এবং জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দল জামাতের শীর্ষ আমির গোলাম আজম-সহ বেশ কয়েক জন নেতাকে বিচারের সম্মুখীন। ইতোমধ্যে বিচারের অনেকগুলি প্রাথমিক রায়ও প্রদান করা হয়েছে। এক জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় সকল আইনি প্রক্রিয়ার শেষে কিছু দিন আগে কার্যকরও হয়েছে। জামাতে ইসলাম ও তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী ইসলামি ছাত্র-শিবিরের কাছে তাই এই বিচার অনেকটা জীবন-মরণের হুমকির মতো। মরিয়া হয়ে সারা দেশে তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে তত্‌পর হয়েছে। গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ, একটি এলাকাকে ঘাঁটি বানিয়ে মুক্ত এলাকায় পরিণত করা, পুলিশের উপর হামলা করে তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইনের ফিশপ্লেট উঠিয়ে দেওয়া, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, গুপ্ত হত্যার আশ্রয় নেওয়া, এগুলিই হচ্ছে বর্তমানে এই চরমপন্থীদের শেষ অস্ত্র।
বর্তমান নির্বাচনে জামাত শিবিরের অংশগ্রহণ আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জামাতকে তার ঘোষণাপত্রে সংবিধানবিরোধী যে-সব বক্তব্য রয়েছে, তা সংশোধনের জন্য সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা তা সংশোধন করেননি। যদিও জামাতের সমর্থক তরুণ প্রজন্মের অনেকেই মনে করে যে, তাদের উচিত হবে যুদ্ধাপরাধীদের দায় গ্রহণ না-করা। পুরোনো অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করে নতুন একটি ইসলামি দল গঠনের কথাও ভাবেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বর্তমান যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম কৌঁসুলি ব্যারিস্টার রাজ্জাকের যে কথোপকথন কিছু দিন আগে উইকিলিক্সে প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও এই কথাই জানা গেছে। রাজ্জাক মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তাঁরা যাতে আওয়ামি লিগকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তা না হলে তাদের দলের জঙ্গি ক্যাডাররা আরও জঙ্গিপথে ধাবিত হবেন এবং তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও বিপন্ন হবে। তিনি যে মার্কিনদের কিছুটা বোঝাতে পেরেছিলেন, তা এখন স্পষ্ট। উপমহাদেশের রাজনীতিতে মার্কিনরা এখন একটি ‘মডারেট ইসলামিক ফোর্স’ হিসেবে জামাতকে টিকিয়ে রাখতে চায়, যদিও ভারত এই প্রশ্নে তাদের সঙ্গে একমত নয়। জামাত অত্যন্ত সুসংগঠিত দল, তাদের বিশাল অর্থভাণ্ডার, অন্ধবিশ্বাসী কর্মী-বাহিনী, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। যদিও ভোটার সমর্থন তাদের খুবই কম, তিন শতাংশের বেশি ভোট কখনওই তারা নির্বাচনে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু অন্য দিকে, বিএনপি ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে একটি জগাখিচুড়ি দল হিসেবে গড়ে উঠেছে, যার প্রতি প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন। ‘ভোটহীন সুসংগঠিত জামাত’ এবং ‘ভোটসম্পন্ন সংগঠিত বিএনপি’ দুটি পরস্পর পরিপূরক শক্তি এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামি লিগকে যথেষ্ট ভোগান্তি শুধু নয়, এমনকী পরাজিত করতেও সক্ষম। বিশেষত যখন আওয়ামি লিগের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নেই এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন জোটের জন্যও তাই এ বারের নির্বাচন অনেকটা জীবন-মরণ প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্নের উত্তর মানুষই দেবেন, আক্ষরিক অর্থে। অতীতেও কয়েক বার ধ্বংস-কিনারা থেকে জনগণই বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছে। প্রধান দুই দল যদি জনগণের চাপে দুটি প্রশ্নে কাছাকাছি আসে এখনও পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। দুই দলকে একমত হতে হবে যে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামাত রাজনীতির নিষিদ্ধকরণ মেনে নিতে হবে। সেই সঙ্গে একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনগণ যে-রায়ই দিক না কেন, তাকে নির্দ্বিধায় মানতে হবে। দলগুলি কি জনগণের এই ইচ্ছেকে মর্যাদা দেবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.