কেবল কাজে আসিলেই মজুরি জুটিবে না, কাজও করিতে হইবে এই কথাটির মধ্যে যে একটি বৈপ্লবিক বার্তা লুকাইয়া আছে, তাহা টের পাইতে হইলে ভারতের রাজনৈতিক মাটিতে কয়েক পা হাঁটিতেই হইবে। কথাটি বলিয়াছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। ইউ পি এ সরকারের ‘পবিত্র গাভী’ জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার প্রেক্ষিতে। প্রকল্পটি ২০০৬ সাল হইতে চলিতেছে। কর্তাদের এত দিন পর উত্পাদনশীলতার কথাটি খেয়াল হইল, ভাবিয়া অবাক হওয়া যায়, আবার স্বস্তির শ্বাসও ফেলা যায় তবু যে মনে হইয়াছে, এই তো অনেক! এই প্রকল্পে গ্রামাঞ্চলে টাকার জোগান বাড়িয়াছে, গ্রামীণ চাহিদাও বাড়িয়াছে। অন্য দিকে, কৃষি শ্রমিকরা অধিকতর মজুরির আকর্ষণে এই খাতায় নাম লিখাইয়াছেন, ফলে কৃষিতে শ্রমিকের জোগানে টান পড়িয়াছে। বাজারে তাহার কী প্রভাব পড়িয়াছে, সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা গত কয়েক বত্সর যাবত্ চলিতেছে। কিন্তু, অধিকতর মজুরিই একমাত্র আকর্ষণ নহে, একশত দিনের কাজ প্রকল্পে নাম তুলিতে পারিলে কার্যত বিনা শ্রমেই বেতন পাওয়া যায় অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই সর্বজনীন বিশ্বাসটিও যথেষ্ট শক্তিশালী। তাহার ফলে, এই প্রকল্পের খাতে যত টাকা বহিয়া গিয়াছে, সেই তুলনায় সম্পদ নির্মিত হইয়াছে সামান্যই। এত দিনে কর্তারা বুঝি তাহা খেয়াল করিলেন।
রমেশ বলিয়াছেন, একশত দিনের কাজের প্রকল্পটি খয়রাতির প্রকল্প নহে, ফলে তাহার সহিত উত্পাদনশীলতার যোগ আবশ্যিক। কথাটি তিনি অভিভাবকদের সহিত আলোচনা করিয়া বলিলেন তো? জন্মলগ্ন হইতেই এই প্রকল্পটি কর্মসংস্থান নিশ্চয়তার প্রতি উত্সর্গীকৃত ছিল, সম্পদ নির্মাণের জন্য নহে। আইন বলিতেছে, কেহ কাজ চাহিলে সরকার তাহাকে কাজ দিতে বাধ্য প্রকৃত উত্পাদনশীল কাজ আছে কি নাই, সেই প্রশ্ন, অতএব, অবান্তর। যত বেশি সম্ভব কর্মসংস্থানের সুযোগ রাখিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ হইয়াছে। ফলে, প্রকল্পটি মূলত মাটি কাটিবার খেলায় পর্যবসিত হইয়াছে বর্ষার পূর্বে কাটা মাটি বর্ষার জলের তোড়ে স্বস্থানে ফিরিয়া গেলে ফের তাহাকে কাটিবার জন্য মজুরি মিলিতেছে। জন মেনার্ড কেইনস মর্মাহত হইতেন। আইন বাঁধিয়া কাজের নিশ্চয়তা দিলে এই পরিণতিই অনিবার্য। সর্বাপেক্ষা মর্মন্তুদ, যে ভোটের মুখ চাহিয়া কংগ্রেস এই মাটি কাটিল, দুর্নীতির তোড়ে সেই মাটিও স্বস্থানে ফিরিয়া গিয়াছে। উত্পাদনশীলতাও থাকিল না, ভোটও নহে। জনপ্রিয়তাই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান না হইলে এই প্রকল্পটিকে গ্রামীণ পরিকাঠামোর আমূল সংস্কারের কাজে ব্যবহার করা যাইত। ভারতের গ্রামগুলি একুশ শতকের ‘ইন্ডিয়া’ হইতে বহু আলোকবর্ষ দূরে পড়িয়া আছে। মূলত পরিকাঠামোর অভাবে। সড়ক নির্মাণ, বিদ্যালয়-স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি কাজে একশত দিনের কাজ প্রকল্পের অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করিলে তাহা বিপুল সম্পদ নির্মাণ করিতে পারিত। কৃষি পরিকাঠামো নির্মাণের কাজেও এই প্রকল্পকে ব্যবহার করা যাইত। গ্রামাঞ্চলে এই কাজগুলির প্রয়োজন প্রশ্নাতীত। টাকাও যখন খরচই হইল, কাজের কাজ করিলেই লাভ হইত। জনমোহনেরও যে উত্পাদনশীল পথ থাকিতে পারে, এই কথাটি রাজনীতিবিদরা বোঝেন না বলিয়াই বিপদ। তবে, লোকসভা নির্বাচনের মুখেও রমেশ যে বর্তমান সিদ্ধান্তটি করিতে পারিয়াছেন, তাহাতে কিঞ্চিত্ ভরসা হইলেও হইতে পারে। |