|
|
|
|
মার্কিন কূটনীতিকদের সুরক্ষা
ও সুবিধা ছেঁটে পাল্টা জবাব দিল্লির |
সংবাদ সংস্থা • নয়াদিল্লি
১৭ ডিসেম্বর |
ভারতীয় কূটনীতিককে হেনস্থার পাল্টা পাটকেল দিতে শুরু করেছে ভারত। তার ফলে মঙ্গলবার থেকে এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে গিয়েছে দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা বেষ্টনী। এত দিন মার্কিন কূটনীতিকরা যে সব সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তারও অনেকগুলি তুলে নেওয়া হয়েছে। শুধু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক ভাবেও বার্তা দিয়ে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছেন রাহুল গাঁধী থেকে নরেন্দ্র মোদী, সকলেই।
আমেরিকার মতো প্রবল প্রতিপত্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ভারতের এমন কঠোর অবস্থান রীতিমতো বিরল ঘটনা। কূটনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন, এর ফলে দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
কিন্তু দিল্লির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্য কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে অনেকেই বলছেন, নিউ ইয়র্কে কর্মরত ভারতীয় ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়ের গ্রেফতারি এবং হেনস্থাকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের কঠোর ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চাইছে। সামনে লোকসভা ভোট। তার আগে চার রাজ্যে গো-হারা হেরেছে শাসক দল কংগ্রেস। এই ঘটনাকে তাই তারা খড়কুটো বলে আঁকড়ে ধরে নিজেদের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও মেরামত করতে চাইছে বলে অভিমত অনেকেরই। না হলে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদী যদি বিষয়টি কেড়ে নেন, সেই ভয়ও রয়েছে। তার ইঙ্গিতও মিলেছে এ দিন। রাজনাথ সিংহ থেকে রবিশঙ্কর প্রসাদ, সকলেই দেবযানীকে হেনস্থার ঘটনার নিন্দা করে দাবি করেছেন, কংগ্রেস যে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সখ্যের কথা বলে, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে সেটা আদৌ সত্যি নয়। যশবন্ত সিনহা আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ভারতে কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকদের মধ্যে কয়েক জন তাঁদের সমকামী সঙ্গীদের নিয়ে এসেছেন। গত সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্ট সমকামী সম্পর্ককে বেআইনি ঘোষণা করেছে। মার্কিন আইন ভাঙায় যদি দেবযানীকে সে দেশে আটক করা হয়, তা হলে তো ভারতেরও উচিত এঁদের জেলে পোরা! আর মোদী? ভারত সফররত মার্কিন কংগ্রেসের পাঁচ জনের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেই থামেননি তিনি, টুইটে ফলাও করে জানিয়েওছেন সে কথা। |
|
মার্কিন দূতাবাসের সামনে থেকে সরানো হচ্ছে ব্যারিকেড। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এএফপি। |
এমন অবস্থা যে হতে পারে, তা আঁচ করেই মার্কিন দূতাবাস ও তাদের কর্মীদের বেশ কিছু কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করল কেন্দ্র। অন্য দিকে, মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে, কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার এক কালে সামলেছিলেন আইএফএসের গুরু দায়িত্ব। অসন্তোষ জানাতে গত কাল মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেননি তিনিও। সম্ভবত একই কারণে বৈঠক বাতিল করেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেছেন, যে দু’টো দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, এমন ব্যবহার সেখানে কাঙ্ক্ষিত নয়। সেটা বাদ দিলেও, মানবিকতার খাতিরেও এমন কাজ বরদাস্ত করা যায় না।
ভারতের কড়া প্রতিক্রিয়ার সামনে পড়ে কিছুটা সুর নরম করেছে ওয়াশিংটন। যদিও দাগি অপরাধীদের মতো দেবযানীর শরীরে কেন তল্লাশি করা হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র মারি হর্ফ জানিয়েছেন, নিয়ম মেনেই তল্লাশি হয়েছে। কোথাও নিয়মের গণ্ডি পেরোননি তাঁরা। তবু দুই দেশের সম্পর্ক যে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সে কথাও জানাতে ভোলেননি তিনি। জানিয়েছেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। গ্রেফতার সংক্রান্ত যাবতীয় কিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বলেছেন, “আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথাও মাথায় রাখছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার বাতাবরণ রেখেই কাজ করতে চাইছি।” মার্কিন বিদেশ দফতরের অতিরিক্ত সচিব নিশা দেশাই বিসোয়ালও জানিয়েছেন, ঘটনাটি ভারতে অনেকের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সেটা তাঁরা বোঝেন। সে কথা মাথায় রেখেই সব খতিয়ে দেখছেন তাঁরা।
যে নজিরবিহীন কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে ভারত সরকার, তা কেমন? |
|
মঙ্গলবার সংসদ ভবনে শিন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে দেবযানীর বাবা উত্তম খোবরাগাড়ে। ছবি: পিটিআই। |
গত বৃহস্পতিবার রাস্তা দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেবযানীকে গ্রেফতার করে মার্কিন পুলিশ। বছর উনচল্লিশের ওই ভারতীয় কূটনীতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পরিচারিকার ভিসায় মজুরি সংক্রান্ত ভুল তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ, গ্রেফতারের পরে দেবযানীকে নগ্ন করে তল্লাশি করা হয়। চোরাচালানকারীদের দেহের বিভিন্ন গোপন অংশ যে ভাবে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়, বাদ যায়নি তা-ও। সবশেষে মাদকাসক্তদের সঙ্গে একই কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। এই খবর জানার পরই হইচই শুরু হয়ে যায়। পর দিনই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলকে ডেকে প্রতিবাদ জানান বিদেশসচিব সুজাতা সিংহ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিবাদ এখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এ যাত্রায় তা হয়নি।
এ দিন বিদেশ মন্ত্রকের নির্দেশে চাণক্যপুরীতে নয়া মার্গে মার্কিন দূতাবাসের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় যাবতীয় ব্যারিকেড। সাধারণের যাতায়াতের জন্য রাস্তাও খুলে দেওয়া হয়েছে। চেয়ে পাঠানো হয়েছে ভারতে কর্মরত সমস্ত মার্কিন কূটনীতিক এবং তাঁদের পরিবারের পরিচয়পত্র। আমেরিকা যদি দেবযানীর সীমিত রক্ষাকবচের যুক্তি দেয়, তা হলে ভারতও একই পথে হাঁটবে জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। গোটা দেশে মার্কিন দূতাবাস ও উপদূতাবাসে যে ভারতীয়রা চাকরি করেন, তাঁদের নিয়ম মেনে বেতন দেওয়া হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে চেয়ে পাঠানো হয়েছে স্যালারি স্লিপ। আমেরিকার কূটনীতিকদের বাড়িতে যে ভারতীয় পরিচারকরা কাজ করেন বাদ দেওয়া হচ্ছে না তাঁদেরও। |
|
আপনার মোবাইলে QR Reader ডাউনলোড করে এই QR
কোডটি স্ক্যান করুন আর দেখে নিন দেবযানীর বাবার প্রতিক্রিয়া। |
কূটনীতিক হওয়ার সুবাদে ভারতে বেশ কিছু বিশেষ সুবিধে পেতেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা। আজ আচমকাই তুলে নেওয়া হয়েছে সে সব। যেমন, এ বার থেকে বিমানবন্দরে আর অগ্রাধিকার পাবেন না মার্কিন কূটনীতিকরা। আলাদা জায়গায় গাড়িও রাখতে পারবেন না তাঁরা। টাকা দিয়ে আর পাঁচ জন নাগরিক যেখানে গাড়ি রাখেন, সেখানেই গাড়ি রাখতে হবে তাঁদেরও। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তাঁদের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা জিনিসের উপরও। তালিকায় থাকছে বিদেশি মদও।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি থেকে ভারতীয় ফিল্মি তারকা এবং উচ্চপদস্থ আমলা গত কয়েক বছরে আমেরিকায় নানা ভাবে হেনস্থা হয়েছেন অনেকে। কিন্তু দেবযানী খোবরাগাড়ের ঘটনাকে এক পংক্তিতে ফেলতে নারাজ ভারত। আজ বিদেশ মন্ত্রক থেকে বলা হয়েছে, দেবযানীর মতো পদস্থ কূটনীতিকের সঙ্গে যে ব্যবহার আমেরিকা করেছে, তা লজ্জাজনক এবং বর্বরোচিত। এই কাজের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে মার্কিন প্রশাসনকে।
দুই সন্তানের মা দেবযানী ১৯৯৯-এর ব্যাচের আইএফএস অফিসার। ২০১২ সালে নিউ ইয়র্কের ডেপুটি কনসাল জেনারেল পদে যোগ দেন তিনি। সে বছরই সঙ্গীতা রিচার্ড নামে এক ভারতীয়কে পরিচারিকা হিসেবে নিয়ে যান
দেবযানী খোবরাগাড়ে |
দেবযানী। আমেরিকায় কর্মচারীদের যে ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার কথা, সঙ্গীতার ভিসায় সেই অঙ্কেরই উল্লেখ করেছিলেন তিনি। অভিযোগ, সঙ্গীতার হাতে দেবযানী যা দিতেন, আসলে তা ছিল অনেক কম। গত বৃহস্পতিবার মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে যাওয়ার সময় ভরা রাস্তা থেকেই আটক করা হয় দেবযানীকে। তার পরে চলে তল্লাশির নামে হেনস্থা। পরে আদালতে দেড় কোটি টাকার বন্ডে ছাড়া পান দেবযানী। আদালতের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনও দেশে আপাতত যেতেও পারবেন না তিনি।
এই পরিস্থিতিতে শিন্দে এবং খুরশিদের সঙ্গে এ দিন দেখা করেন দেবযানীর বাবা উত্তম খোবরাগাড়ে। তাঁর অভিযোগ, খুন বা চোরাচালানের মতো কোনও গুরুতর অপরাধের অভিযোগ তো তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁর সম্মান নিয়ে এ ভাবে কেন ছিনিমিনি খেলা হল? তাঁর দাবি, মার্কিন বিদেশ দফতর ও ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মধ্যে টানাপোড়েনেই বলির পাঁঠা হল তাঁর মেয়ে। তবে দেবযানীর সুরক্ষার প্রশ্নে সরকার যে কোনও রকম আপস করবে না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে সেই আশ্বাসও দিয়েছেন।
|
কড়া কদম |
• দূতাবাসের সামনে থেকে সরলো ব্যারিকেড। সামনের রাস্তাও খুলে দেওয়া হল সাধারণ মানুষের জন্য।
• দূতাবাসে চাকরিরত ভারতীয়দের স্যালারি স্লিপ, পরিচারকদের বেতন সম্পর্কিত তথ্যও চাওয়া হল।
• বিমানবন্দরে দূতাবাসের গাড়ির জন্য আলাদা ব্যবস্থা নয়। গাড়ি রাখতে হবে সাধারণ পার্কিংয়ে।
• আমদানির ছাড়পত্র বাতিল কূটনীতিকদের। কিছু আনা যাবে না বিদেশ থেকে।
• সব মার্কিন কূটনীতিক, কর্মী এবং পরিবারের পরিচয়পত্র তলব।
• বিমানবন্দরে অন্যদের মতোই শুল্ক পরীক্ষা ও তল্লাশি কূটনীতিকদের।
• মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক বাতিল মীরা কুমার, শিন্দে, রাহুল এবং মোদীর। |
|
পুরনো খবর: ধৃত দেবযানীকে রক্ষাকবচ নয়, জানাল আমেরিকা |
|
|
|
|
|