অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কমিটির কাছে দেওয়া মহিলা ইনটার্নের হলফনামা প্রকাশ্যে এনে নতুন বিতর্ক তৈরি করলেন ভারতের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল (এএসজি) ইন্দিরা জয়সিংহ। আইনি পদে আসীন এক জন কোন এক্তিয়ারে ওই বয়ান এ ভাবে প্রকাশ্যে আনলেন, এ দিন সেই প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদের অনেকেই।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমের তৈরি তিন বিচারপতির কমিটির কাছে ওই হলফনামা জমা দিয়েছিলেন অভিযোগকারিণী ইনটার্ন। গত বছর ২৪ ডিসেম্বর হোটেলের ঘরে অশোকবাবু তাঁর যৌন হেনস্থা করেছেন বলে সেখানে অভিযোগ করেছিলেন ওই মহিলা। যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তিনি হলফনামায় সুপ্রিম কোর্টের কমিটির কাছে জানান। গত কাল সেই গোপন হলফনামা প্রকাশ্যে আনার পরে এ দিন ফের অশোকবাবুর পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছেন ইন্দিরা জয়সিংহ। বলেছেন, “এ বারও যদি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ইস্তফা না দেন, তা হলে রাষ্ট্রপতি তাঁকে সরাতে সক্রিয় হবেন।”
কিন্তু এএসজি-র পদে থেকে ইন্দিরা জয়সিংহ যে ভাবে দেশের শীর্ষ আদালতের কাছে জমা দেওয়া গোপন হলফনামা সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ আইনজ্ঞ মহলের অনেকেই। ইন্দিরার অবশ্য দাবি, তিনি মেয়েটির সম্মতিক্রমেই ওই বয়ান প্রকাশ্যে এনেছেন। কিন্তু আইনজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, আইন বিভাগের পদস্থ কর্তা হিসেবে তিনি কোনও পক্ষ নিতে পারেন না। উল্টে তিনি যে ভাবে অশোকবাবুর পদত্যাগ চেয়ে সক্রিয় ভাবে প্রচারে নেমেছেন, তা-ও তাঁর পদে থেকে করা সমীচীন নয়। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ যেমন বলেছেন, “অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল হিসেবে ইন্দিরা জয়সিংহের এটা বলা উচিত হয়নি।” |
লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার তথা আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও এ দিন বলেন, “মেয়েটি তো প্রকাশ্যে অভিযুক্তের নাম বলেননি। সুপ্রিম কোর্টের এক জন অফিসার তা হলে সেই নাম বললেন কী ভাবে?” সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, “আমি কাউকে সার্টিফিকেট দিচ্ছি না। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই কেন তাঁকে (অশোকবাবুকে) দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না। সুপ্রিম কোর্টে বিচার হল না, অ্যাডহক কমিটি তাদের মতামত দিল আর যাবতীয় নথি প্রকাশ্যে এল। এ কেমন ব্যাপার?”
সোমনাথবাবুর সুরেই প্রশ্ন তুলে অরুণাভবাবু এ দিন বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের তিন জন বিচারপতির যদি বিচারেরই এক্তিয়ার না থাকে, তা হলে অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করে তঞ্চকতা করা হল কেন?” যে ভাবে বিষয়টি নিয়ে একটা অংশ সরব হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অরুণাভবাবু বলেন, “গোটা বিষয়টি অঙ্ক কষে করা হয়েছে। তাই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।”
আর যাঁকে ঘিরে এত বিতর্ক? সেই অশোকবাবু গোপন বয়ান প্রকাশ্যে আনা প্রসঙ্গে সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর কথায়, “মেয়েটি যে গোপন বয়ান দিয়েছেন, তা এখন সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি। সেটা ফাঁস করাটা অপরাধ কি না, তা নিয়ে আমি কিছু বলব না। আইনজ্ঞদের জিজ্ঞাসা করুন।” রাজ্য মানবাধিকার চেয়ারম্যানের পদ থেকে এখনও না সরার সিদ্ধান্তেই অটল অশোকবাবু সোমবারও অফিসে এসে কাজ করেন। এ দিনও তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “আমি তো প্রথম থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছি।”
অশোকবাবুর ইস্তফার দাবিতে এ দিনও অবশ্য দিল্লিতে সরব হয় বাম-সহ সব দলই। আজ রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হামিদ আনসারির ডাকা লোকপাল নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকে এ ব্যাপারে প্রায় সকলে এক সুরে কথা বলে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাল রাজ্যসভায় লোকপাল বিল নিয়ে আলোচনার আগে অশোকবাবুর পদত্যাগ প্রসঙ্গে কথা হবে। সংসদীয় সচিবালয় সূত্রের খবর, কাল প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুর দশ মিনিট স্থগিত রাখা হবে। তখনই অশোকবাবুর ইস্তফা নিয়ে সরব হবেন বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি।
কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’দলেরই অভিযোগ, অশোকবাবু প্রাক্তন বিচারপতি বলে তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল বিচারব্যবস্থার একাংশ। আজ বিচারব্যবস্থাকেও একযোগে কটাক্ষ করেন বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি এবং কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল। জেটলির কথায়, “যদি বিচারপতির বদলে নামী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠত, তা হলে কি হাত ধুয়ে ফেলত শীর্ষ আদালত?” সিব্বলও টুইটারে লিখেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে সক্রিয় হয়ে পদক্ষেপ করে কি না, তা দেখার জন্য সরকার অপেক্ষা করছে।” সিব্বল এবং জেটলির মন্তব্য প্রসঙ্গে অশোকবাবু বলেন, “ওঁদের কথা ওঁরা বলেছেন।”
সুপ্রিম কোর্টের কাছে ওই ইনটার্ন যে হলফনামা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি দাবি করেন, ঘটনার দিন রাতে প্রাক্তন বিচারপতি একটি রিপোর্ট শেষ করতে হবে বলে তাঁকে হোটেলে ডাকেন। ইনটার্নের কথায়, “পরের দিন সকালেই রিপোর্ট জমা দিতে হবে বলে উনি জানান। তাই রাতে হোটেলে থেকে কাজ শেষ করতে বলেন। তাতে রাজি হইনি। বলি, কাজ শেষ করে যেখানে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকি, সেখানেই ফিরব।” ইনটার্নের দাবি, এই সময়ে অশোকবাবু মদের বোতল বার করেন। বলেন, ‘‘সারা দিন অনেক ধকল গিয়েছে। আমার বেডরুমে গিয়ে মদ খেয়ে রিল্যাক্স করো।’’ যা শুনে ইনটার্ন বিব্রত এবং বিরক্ত হন। কিন্তু প্রাক্তন বিচারপতি বলতেই থাকেন, “তুমি খুব সুন্দর।” ইনটার্নের বক্তব্য, “ওই কথা শুনে উঠে পড়ি। আমি কিছু বলার আগেই তিনি আমার হাত ধরে বলেন, ‘তুমি তো জানো, আমার তোমাকে ভাল লাগে, জানো না? ...আমি সত্যি তোমায় পছন্দ করি। তোমায় ভালবাসি আমি।’ সব শুনে আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে উনি আমার হাতে চুমু খান এবং আবার বলেন, তোমায় ভালবাসি।”
|