|
|
|
|
কোয়ার্টার ফাইনালের আশা বাঁচিয়ে রাখল বাংলার আট উইকেটে জয় |
দিন্দার বারবিকিউ পুড়িয়ে মারল উত্তরের ক্রিকেট-গর্ব
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
বাড়িতে থাকলে অশোক দিন্দার মাঝে মাঝে একটা ইচ্ছে জাগে। রান্না করার ইচ্ছে! বহু দিন ধরে কলকাতায় একা থাকতে থাকতে অভ্যেসটা হয়ে গিয়েছে। সদ্য বিয়ে করেছেন। কিন্তু স্ত্রী-কে বিশেষ হেঁসেলের দিকে যেতে দেন না। বরং নিজেই এটা-ওটা রান্না করে দেন। বেশির ভাগই নাকি বাঙালি রসনা এবং রান্নার হাতটাও নাকি মন্দ নয়! ক্লাবহাউসে তাঁর স্ত্রী শ্রেয়সীর মুখেই ব্যাপারটা শোনা গেল।
মুশকিল হচ্ছে, শুধু বাঙালি রান্না নয়। অশোক দিন্দা ‘বারবিকিউ’-টাও বেশ ভাল করেন। ওই হাতটাও যথেষ্ট ভাল, যদিও তা হল বাইশ গজে, পেসের আগুনে!
একটা টিমের যদি সাত-সাতটা উইকেট একাই তুলে নেন বঙ্গ পেসার, যদি মাত্র দু’শো চুয়াল্লিশ মিনিটে বিপক্ষের অন্তিম-সংস্কার ঘটিয়ে দেন প্রায় একা, চার দিনের রঞ্জি ম্যাচ যদি শেষ করে দেন আড়াই দিনেই‘বার-বি-কিউ’ ছাড়া আর কী বলা যায়? ইংরেজিতে ‘কুকিং দ্য অপোনেন্ট’ বলে একটা কথা আছে। সোমবার দিন্দার আগুনে বোলিংয়ের সঙ্গে মাঠের প্রবচনটা মিলে গেল অনায়াসে।
২৪.৪-৬-৮২-৭! সব মিলিয়ে ম্যাচে মোট দশটা!
ইনিংসে সাত উইকেট দিন্দার ক্রিকেটজীবনে নতুন নয়। দলীপে আট উইকেট আছে, রঞ্জিতেও বেশ কয়েক বার সাতটা তুলেছেন, কিন্তু তাঁর আজকের সাত মহানায়কীয় তিনটে ব্যাপারে। |
২৪.৪-৬-৮২-৭
সাতের শাসন। সোমবার ইডেনে দিন্দা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
প্রথমত, বঙ্গ অধিনায়কের ইনিংসকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে বাংলার সামনে কোয়ার্টার ফাইনালের দরজা কিছুটা হলেও খুলে ফেলল তাঁর পারফরম্যান্স। দ্বিতীয় কারণ, তিনি নিজে। দু’দিন মিলিয়ে টানা চব্বিশ ওভার কোনও বাংলা পেসার শেষ কবে করেছেন, কেউ মনে করতে পারছেন না। ফিটনেস নিয়ে সামান্যতম সমস্যায় পড়লেন না, বরং এমন কিছু বিষাক্ত আউটসুইং বেরোল যার সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্যাট এগিয়ে মৃত্যু-আবাহনে বাধ্য হল উত্তরের ব্যাটসম্যানরা। অ্যাকশন আগের চেয়ে কিছুটা পাল্টেছেন। গতি কমিয়েছেন। আউটসুইং করাচ্ছেন। কিন্তু দরকারে ডেকেও হিট করছেন ঠিকঠাক। এবং বদলে লাভ হয়েছে দিন্দার। প্রমাণবোলিংয়ে বৈচিত্র-যোগ। প্রমাণচলতি রঞ্জি মরসুমে এখনও পর্যন্ত ঊনত্রিশ উইকেট। প্রমাণ ইডেনে তাঁর আজ পর্যন্ত নিজের সেরা বোলিং। তৃতীয়ত, দিন্দা বুঝিয়ে দিলেন মহম্মদ শামি না থাকলেও বাংলা বোলিং অথর্ব হয়ে পড়বে, এমন নয়।
সোমবারের দুর্ধর্ষ জয়ের পর গ্রুপের যা অবস্থা, তাতে বাংলা তিন নম্বরে। বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে পয়েন্টে তেমন তফাত নেই, কিন্তু বাংলা ম্যাচ খেলেছে বেশি। স্থানীয় ক্রিকেটমহলে কেউ কেউ বলাবলি করছেন যে, বাংলা ব্যাটসম্যানদের উচিত ছিল আজ বোনাস পয়েন্ট নিয়ে জেতা। দশ উইকেটে জিতলে যেটা হত। দরকার তো ছিল মাত্র ৬৯। তার উপর রুদ্রপ্রতাপ সিংহ যেখানে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে আক্রান্ত হয়ে বল করতে পারলেন না। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, বোনাসের এক পয়েন্টই না শেষ আটের রাজপথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়!
যা হয়নি, হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে, সেটাও কম নয়। ইডেনে দিন্দার অভুত্থ্যান রূপকথা হলে, টিমের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাহিনিও সমান আকর্ষণীয়।
ক’জন জানেন, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়কে ক্লাব ক্রিকেটের প্রথম উপার্জন দিয়ে শপিং মলে যাওয়া নয়, বাড়িতে ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল?
ক’জন জানেন, একটা সময় ক্রিকেট নয়, ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায় দাবার বেশি মনযোগী ছাত্র ছিলেন? চশমা পরে ভারিক্কি দেখানোর জন্য ময়দান যাঁকে ডাকছে প্রফেসর!
ক’জন জানেন, বছর আঠারোর অভিমন্যু ঈশ্বরণের সারা বছর নিশ্বাস ফেলার উপায় থাকে না। গোটা ভারতবর্ষ ঘুরতে হয় বিভিন্ন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলে নিজেকে তৈরি করতে? |
শেষ আটের অঙ্ক |
• ৭ ম্যাচে ১৮ পয়েন্ট পেয়ে বাংলা এখন গ্রুপে তৃতীয়। আগে আছে রেল (৫ ম্যাচে ২০) এবং উত্তরপ্রদেশ (৬ ম্যাচে ২০)।
• বাংলা শেষ ম্যাচে তামিলনাড়ুকে হারিয়ে ৬ পয়েন্ট পেলেও তাকিয়ে থাকতে হবে বাকিদের দিকে।
• শেষ ম্যাচে তিন পয়েন্ট পেলে তিন নম্বর দল হিসাবেও বাংলার ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। সেক্ষেত্রে লড়াই হবে সৌরাষ্ট্র (৫ ম্যাচে ১৫), তামিলনাড়ুর সঙ্গে (৫ ম্যাচে ১৪)। দুটো দলেরই ষষ্ঠ ম্যাচ চলছে।
• বাংলার সমস্যা, হাতে মাত্র একটা ম্যাচ। বাকি দলগুলো দুটো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে। |
|
ওই তিন জুনিয়রের মধ্যে ইডেনের সদ্যসমাপ্ত রঞ্জি সবচেয়ে সুখকর হয়ে থাকছে সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের। দিন্দা যে সাতটা উইকেট পেলেন, তার দু’টোর ক্ষেত্রে সুদীপ অর্ধেক কৃতিত্ব দাবি করলে অন্যায় হবে না। স্লিপে দু’টো ক্যাচ, দু’টোই অসাধারণ। বিশেষ করে প্রশান্ত গুপ্তের ক্যাচ। দিন্দার আউটসুইং প্রশান্তের ব্যাটে চুমু খেয়ে সুদীপের নাগালের অনেক বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল। সত্তর শতাংশ ক্ষেত্রে ওই ক্যাচ পড়বে। এটাও পড়ল, তবে পড়ল সুদীপের হাতে, ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষিপ্রতায় ডান দিকে ঝাঁপিয়ে, ক্রিকেট ম্যানুয়াল মেনে দু’টো হাতের মধ্যে, এক হাতে নয়। ব্যাটটা তিনি কেমন করেন, হিমশীতল চাপকে পরাভূত করা ছেষট্টিতেই বোঝা গিয়েছে। এ দিন বোঝা গেল, সুদীপের ফিল্ডিংও তাঁর ব্যাটের মতোই ক্ষুরধার। আর এমন কাঠিন্যও তাঁর রাতারাতি আমদানি নয়। খুব ছোট থেকে সুদীপকে তাঁর অ্যাকাডেমির কোচ বোঝাতেন, ক্রিকেটটা তাঁর জীবনে বিলাসিতা নয়। রুটি-রুজি। যা দিয়ে তাঁকে পরিবারের অন্নসংস্থান করতে হবে। রুক্ষতা তাই তাঁর সহজাত, অর্জিত নয়। অনূর্ধ্ব-পনেরো থেকে বাংলা দলে ঢোকার প্রত্যেক ধাপে তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করেছেন। প্রথম যে নির্বাচক তাঁকে বাংলার অনূর্ধ্ব পনেরো দলে ঢুকিয়েছিলেন, বর্তমানে সিএবি যুগ্ম-সচিব সুজন মুখোপাধ্যায় গর্বিত ভাবে এ দিন বললেন, “দেখে মনে হয়েছিল, ছেলেটা হারতে শেখেনি। তাই নিয়েছিলাম। দেখলাম, ভুল করিনি।” ঠিক যেমন বাংলার নির্বাচক কমিটি বলে দিল, তাদের ‘প্রোজেক্ট বেঙ্গল’-এ এ বার থেকেসুদীপ। ঋত্বিক। অভিমন্যু।
বিশ্বাস, ভরসার যে ছবি আরও ভাল করে পাওয়া গেল দুপুর আড়াইটে নাগাদ।
বাংলা ড্রেসিংরুমের বাইরে অভিমন্যু ঈশ্বরণের বাবাকে পইপই করে একটা কথা বুঝিয়ে চলেছেন লক্ষ্মীরতন শুক্ল। কোনও ভাবেই ছেলেকে নিয়ে মিডিয়ায় কথাবার্তা নয়। বলে দিলেন, তাঁর কিশোর ছেলে প্রতিভাবান, বাংলা তাঁকে নিয়ে ভাবছে। একটু পরেই অভিমন্যুকে দেখে দাঁড় করিয়ে দিল মিডিয়া। বাংলা অধিনায়কের চোখ সে দিকে যেতেই জুনিয়রকে টেনে রামধমক! বোঝা গেল, বর্তমান আগলে রাখতে চাইছে আগামীকে। ভবিষ্যতের জন্য।
এক বছর আগেও এ সব কোথায় ছিল? |
সংক্ষিপ্ত স্কোর
উত্তরপ্রদেশ ২১২ ও ১৪০ (মোর্তাজা ৪৩ ন:আ:, দিন্দা ৭-৮২, সৌরভ ৩-৩৩)
বাংলা ২৮৪ ও ৭০-২ (সায়নশেখর ২৮ ন:আ)
বাংলা ৮ উইকেটে জয়ী। |
পুরনো খবর: লক্ষ্মীর সাধনায় পুনর্জাগরণ বাংলার |
|
|
|
|
|