|
|
|
|
লক্ষ্মীর সাধনায় পুনর্জাগরণ বাংলার
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
শীতের রবিবাসরীয় সকালে বাইশ গজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছিল লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র। একটু টেনশন, মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা, পেশিতে কেমন যেন আসুরিক শক্তির ইঙ্গিত।
জীবন, পরিবার, টিমের ভীতসঙ্কুল পরিস্থিতি, ক্লাবহাউসের বক্সে বসা স্ত্রী-পুত্র সব মস্তিষ্ক থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছিল। স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়েছিলেন এক বার, দেখেছিলেন বাংলা ৫০-৪, ঘোরের মধ্যে নিজেকে নিজে বলে ফেলেছিলেন, “আজ খারুশ ক্রিকেট খেলতে হবে!”
‘খারুশ’ শব্দটা বঙ্গদেশীয় নয়। মরাঠি। অর্থ খুব সহজ রুক্ষ ক্রিকেট। কাঠিন্যের ক্রিকেট।
কিন্তু আজকের পর যদি বাংলার ক্রিকেট-অভিধানে শব্দটা ঢুকে পড়ে, যদি আজকের পর পাড়ার ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে কচিকাঁচাদের বলা শুরু হয়, ‘এলআরএসের খুনে মনটা নে’, ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির পর যদি অধিনায়কত্বে নতুন চরিত্রের খোঁজ পায় বাঙালি খুব দোষ দেওয়া যাবে না। লক্ষ্মীরতন শুক্ল ফেলুদা সিরিজ পড়েছেন কি না, জানা নেই। কিন্তু সেখান থেকে ধার করেই তাঁর অধিনায়কত্বের বিশেষণ আমদানির ইচ্ছে হবে।
ক্যাপ্টেন স্পার্ক! |
ব্যাটের কশাঘাত। রবিবার লক্ষ্মী। |
যিনি অসহ্য চাপের মুখে অনায়াসে পারফর্ম করবেন। বারবার। ব্যাটের বারুদে এমন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেবেন বাকি দশের শিরা-উপশিরায় যে, টিমটা তেতে উঠে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চাইবে বিপক্ষকে! ব্যাকফুট থেকে ফ্রন্টফুটে বাংলাকে টেনে আনবে কয়েক ঘণ্টায়, অধিনায়কের একটা ১১৭ রানের দুর্ধর্ষ ইনিংস টিমকে পৌঁছে দেবে সেই মোহনায়, যেখান থেকে ছ’পয়েন্টের স্বপ্নকে বাস্তব মনে হবে। খুব সহজে, লক্ষ্মীর অমর ইনিংসের পর উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে বাংলার হারা কঠিন। বরং বাংলাই এখন জিততে পারে! লিড এখনও ২২ রানের। দ্বিতীয় ইনিংসে উত্তরপ্রদেশের তিনটে চলে গিয়েছে।
মহম্মদ কাইফরা বোধহয় আন্দাজও পাননি, এ দিন এমন দুর্দশা তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। রুদ্রপ্রতাপ সিংহদের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ইডেনের প্রথম ঘণ্টার উইকেট, টিমের রানের হাফসেঞ্চুরির মধ্যে ড্রেসিংরুমে বাংলার চার ঘরের টিমকে ঘরের মাঠেই পেস-তাণ্ডবে খতম করে ফেলার উপযোগী প্লট। কাঁটা বলতে শুধু বাংলা অধিনায়ক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তাঁরা ব্যাটসম্যান লক্ষ্মীরতনকে চিনতেন। তাঁর জীবনদর্শন নয়। জানতেন না, খুব ছোট থেকে তাঁর পছন্দের ব্যক্তিত্বের নাম মহম্মদ আলি। পরের দিকে স্টিভ ওয়। যাঁরা মার সহ্য করে পাল্টাটা দিতেন। সন্ধের দিকে লক্ষ্মী বলছিলেন, “ওঁদের দেখে একটা জিনিস শিখেছিলাম। ড্রেসিংরুমে বসে থাকার চাইতে বাইরে গিয়ে মার খাওয়া ভাল।” আজও রুদ্রপ্রতাপের বল লক্ষ্মীর কব্জি ফুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওই রুদ্রের বাউন্সারেই সপাট হুকে বিশাল ছক্কাও এসেছে। অমিত মিশ্র নামের উত্তরের পেসারকে তো একটা সময় মোটামুটি কাঁদিয়ে ছাড়লেন, ওভারে নিয়ম করে একটা ওভার বাউন্ডারি, দু’টো বাউন্ডারি মেরে! আরপি সিংহ, ইমতিয়াজ আহমেদ, অমিত কেউ নির্মম প্রহার থেকে বাদ গেলেন না। সবচেয়ে কপাল খারাপ পীযূষ চাওলার। বাংলা অধিনায়কের ব্যাটিং-বিস্ফোরণ থামাতে গিয়ে নিজেরই ম্যাচ থেকে প্রায় উড়ে যাওয়ার দশা! প্রথম বলটাই এমন সপাটে বাঁ কাঁধে আছড়ে পড়ল, বাকি সময়ে স্লিং পড়ে ঘোরাঘুরি।
ক্রিকেটার কম, এ তো মহম্মদ আলি বেশি! |
শতরানের পর। |
এবং ১১৯ বলে ১১৭ রানের ইনিংসের ষোলোটা বাউন্ডারি, তিনটে ওভার বাউন্ডারির একটারও শুকনো রেকর্ডবইয়ে আটকে থাকা উচিত নয়। ভারত তাঁকে ডাকে না। ভাবে না। সবুজ পিচে পরের পর সেঞ্চুরির পরে না। বোর্ডের বর্ষসেরা অলরাউন্ডার হওয়ার পরেও না। ওগুলো তাই জাতীয় নির্বাচক কমিটির গালে এক-একটা সশব্দ থাপ্পড়। দেবাঙ্গ গাঁধীর প্রাক্তন বাংলা নির্বাচক কমিটিও নিজেদের অন্যায় বুঝতে পারল কি? দু’বছর আগে এই লক্ষ্মীকেই তো অধিনায়কত্ব থেকে সরানো হয়েছিল। সৌরাশিস লাহিড়ীকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যার পরই রঞ্জিতে বাংলার পতন শুরু। সৌরাশিস এখন বলে কামব্যাক করেছেন, ব্যাটে আরপি-কে ওভারে চারটে বাউন্ডারিও মারছেন। আর লক্ষ্মী? এক ইনিংসে এমন সঞ্জীবনী মন্ত্রের খোঁজ দিলেন যে, সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে টিমটা খেপে উঠল। ক্রিকেটকে আঁকড়ে ছোটবেলায় দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধের যোগ্য মর্যাদা এ দিন পেয়ে গেলেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লম্বা স্ট্রাইড ব্যবহার, কাট-ড্রাইভ, লক্ষ্মীকে সাহায্য, অনেক দিন মনে থাকবে। অভিষেক ঘটানো ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়কে স্লিপে দেখলে মনে হবে বল কেন, ব্যাকটেরিয়াও গলবে না! অশোক দিন্দাকে খেলা দূরে থাক, দেখলেও কাঁপছেন উত্তরপ্রদেশ ব্যাটসম্যানরা। সৌরভ সরকারের সুইংয়ের সামনে আবার উত্তরের ব্যাটিং-শিরদাঁড়ায় কনকনে উত্তুরে হাওয়া বইছে!
রাতে সব শুনে হেসে ফেললেন বাংলা অধিনায়ক। বললেন, “কাউকে জবাব দিতে ইনিংসটা খেলিনি। ঠিক করেছিলাম সব ভুলে খারুশ ক্রিকেট খেলব।” যে ক্রিকেট-ব্র্যান্ড আরও দু’টো দিন লক্ষ্মীরতন চান টিমের থেকে। যে আগুনে প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে সংসারে চাইছেন ছ’পয়েন্ট। চাইতেই পারেন। কত রান দ্বিতীয় ইনিংসে তাড়া করতে হবে, রবিবারের পর থেকে সে সব নিয়ে আর টিমের চিন্তা হওয়া উচিত নয়। কেউ না পারলে তিনি তো আছেন, থাকবেন।
শ্রীযুক্ত বঙ্গ ক্রিকেট! |
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলা ২৮৪ (লক্ষ্মী ১১৭, ঋত্বিক ৬৬)
উত্তরপ্রদেশ ২১২ ও ৫০-৩ (মুকুল ব্যাটিং ২৭, দিন্দা ২-৩৬, সৌরভ ১-১৪) |
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
পুরনো খবর: বোলিং বিস্ফোরণেও বাংলা ব্যাকফুটে রুদ্র-প্রতাপে
|
নির্বাচক সাবার কাছে লক্ষ্মীর হয়ে সওয়াল বাংলার কোচের
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রবিবারের ইডেনে তাঁর খুনে সেঞ্চুরির পর বাংলা অধিনায়কের প্রশংসায় ভরে গিয়েছে তাঁর ফেসবুক আর টুইটার প্রোফাইল। ভক্তেরা প্রশ্ন তুলেছে, এ রকম দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরেও কেন তাঁকে জাতীয় দলে ব্রাত্য করে রাখা হবে? সেই দাবিতে এ বার গলা মেলালেন বাংলা কোচ অশোক মলহোত্রও। লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র ১১৭ রানের ইনিংস দেখে উঠে। বাংলা বনাম উত্তরপ্রদেশ ম্যাচ দেখতে এ দিন ইডেনে হাজির ছিলেন পূর্বাঞ্চল থেকে জাতীয় নির্বাচক সাবা করিম। যাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় বাংলা কোচের। জানা গেল লক্ষ্মীর সেঞ্চুরির পরপরই সাবা করিমের কাছে অশোক প্রশ্ন তোলেন, কি করে এর পরেও লক্ষ্মীকে জাতীয় ওয়ান ডে দলের জন্য ভাবা হবে না? উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে গ্রিন টপে এ দিনের সেঞ্চুরি তো হাতে গরম প্রমাণ আছেই। সঙ্গে অশোক তুলে আনেন সৌরাষ্ট্র ম্যাচে লক্ষ্মীর সেঞ্চুরির কথাও। বলেন, ইডেনের ওই ম্যাচেও কিন্তু গ্রিন টপে ব্যাট করে ১৫৫ রান করে গিয়েছিলেন বাংলা অধিনায়ক। রবিবার করলেন ১১৭, উত্তরপ্রদেশের মতো শক্তিশালী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে। যা শুনে সাবা করিম বাংলা কোচকে বলেন, জাতীয় নির্বাচকদের মধ্যে বিক্রম রাঠৌরের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর কথা হয়েছে। রাঠৌরও নাকি লক্ষ্মীর প্রশংসা করেছেন। সব শুনে লক্ষ্মী নিজে এ দিন সন্ধ্যায় বলছিলেন, “আমি তো এই বছর দুয়েক আগে বোর্ডের বর্ষসেরা অলরাউন্ডার হয়েছিলাম। তার পরেও তো জাতীয় দলে ডাক পাইনি। ও সব নিয়ে ভাবছি না। কারণ ভেবে লাভ নেই। এখন শুধু বাংলার উপর ফোকাস রাখছি। আমার কাজটা আমি করে যেতে চাই। বাকি যা হওয়ার হবে।” |
|
|
|
|
|