কড়াইয়ে মুরগির মাংস চড়েছে। আদা-রসুন বাটা আর চিকেন মশলার গন্ধে ম-ম করছে ঘর।
ঘরের প্রান্তে ডাঁই করা কম্বল। গৃহকর্তারা পাশে কড়ি গুনছেন। সেই সঙ্গে গভীর আলোচনা এর পরে ‘হাওয়া খেতে’ যাওয়া কোথায়? কার ভল্ট এ বার ‘ভল্ট’ দেবে?
বেতনভুক রাঁধুনির অবশ্য সে সব কথায় নাক গলানো মানা। তারা সকাল-সকাল স্পিকটি নট হয়ে বাজার সেরেছে, দুপুরে হাঁড়ি-কড়া ধুয়ে বিকেলে সব্জি কুটেছে, সাঁঝে রান্না চড়িয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ থেকে ভাড়া করে তিন রাঁধুনি আনা হয়েছে। কিন্তু খুন্তি নাড়ছে মাত্র এক জন। সব কথা তো সবার শোনা ঠিক নয়! বাকি দুই রাঁধুনি দরজার বাইরে হাওয়া শুঁকছে। শীতের সন্ধ্যায় ঘাপটি মেরে এ দিক-ও দিক চাইছে। ‘পুলিশ-পুলিশ গন্ধ’ পেলেই খুকখুক কাশি দেবে।
ভালই চলছিল। বলাগড় থেকে কালনা, কালনা থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে নদিয়া দিনে কম্বল, রাতে চম্বল! উত্তরপ্রদেশের কাদের চক থানা আর বুদায়ুন জেলা থেকে কম্বলের কারবারি সেজে প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি। আর বিক্রিবাটার ফাঁকে রেকি করে নেওয়া। তার পরেই সময় সুযোগ বুঝে অ্যাকশন শুরু। |
কম্বল বিক্রির আড়ালে দিব্যি চিনে আসা ঘর-গেরস্থালিতে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল তারা। ব্যাঙ্ক বা ওষুধের দোকানে লুঠপাটের দৌলতে বাজার বেশ জমে উঠেছিল। বর্ধমানের মেমারি স্টেশন লাগোয়া এলাকায় দিব্যি ঘরভাড়া নিয়ে দিব্যি জমিয়ে বসেছিল ১০-১২ জনের দলটি। তবে একই লোক নয়। মুখগুলো মাঝে-মধ্যে বদলে যাচ্ছিল। সোনাদানা, নগদ টাকা কিছু লোক ফিরে যাচ্ছিল মুলুকে, নতুন গ্যাং আসছিল।
ঢ্যাঁড়া পড়ে গেল হুগলির বলাগড়ে ব্যাঙ্ক ডাকাতির পরে। ব্যাঙ্ক থেকে চুরি গেছিল মোবাইল। সেটিরই সূত্র ধরে পুলিশের হাতে এসে গেল কয়েকটি ‘মেসেজ’, যাতে ব্যাঙ্ক নিয়ে কথাবার্তা ছিল। টাওয়ার লোকেশন খতিয়ে দেখা গেল, কাদের চক এবং বুদায়ুন জেলার ওড়িয়া গ্রামে বারে বারেই মোবাইলে কথা আর মেসেজ চালাচালি হয়েছে। পুলিশের মনে পড়ে গেল, বলাগড় ছাড়া হাওড়ার আমতাতেও ভল্ট ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। বর্ধমানের কালনায় ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে, নদিয়াতেও। দু’মাসে হুগলির বলাগড়, মগরা, ধনেখালিতে ব্যাঙ্ক ছাড়াও সোনার দোকানেও ডাকাতি হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাকাতির কায়দা ছিল প্রায় একই।
হুগলির পাণ্ডুয়া থানার ওসি প্রদীপ দাঁ-র নেতৃত্বে পুলিশ ‘রেকি’ শুরু করেছিল। শেষমেশ রবিবার রাতে পাণ্ডুয়ার গোয়াড়া জি টি রোডের ধারের একটি বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। পাহারায় থাকা রাঁধুনিরা খুকখুক কাশার সময় পায়নি বোধহয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জালে জড়িয়ে যায় দশ গুণধর। পুলিশের দাবি, ডাকাতির উদ্দেশ্যেই তারা সেখানে ফের জড়ো হয়েছিল। তাদের কাছে ৪টি পাইপগান, ২০ রাউন্ড গুলি, ৮টি মোবাইল ফোন, শাবল, কাটার ও বড় হাতুড়ি পাওয়া গিয়েছে। তাদের জেরা করে মিলেছে ৪০০ কেজি সোনার এবং ২০০ কেজি রুপোর গয়না।
তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসার বলেন, “আশ্চর্য কায়দা! ধৃতেরা দিনের বেলায় কম্বল বিক্রি করার অছিলায় এলাকায় নজরদারি চালাত। রাতে অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি নিয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ভল্ট ভাঙত এবং সোনার দোকানে ডাকাতি করত। হুগলির পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী বলেন, “এই দলে আরও কেউ রয়েছে কি না, তা দেখা হচ্ছে। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের এদের যোগাযোগ রয়েছে কি না, তা নিয়েও তদন্ত হচ্ছে।”
সোনাদানা গিয়েছে, বাবুরাও জেলে। পড়ে শুধু ডাঁই করা কম্বল। |