|
|
|
|
সাক্ষাত্কার... |
গরিবের নামে অপচয় কমানোই চ্যালেঞ্জ |
দারিদ্র কমানোর প্রকল্পগুলো কি প্রত্যাশিত ফল দিচ্ছে? উত্তর খুঁজতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে
২০০৩
ডিসেম্বরে শুরু হয় ‘আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ (জে-প্যাল)।
৫৫টি দেশের
প্রায় সাড়ে
চারশো প্রকল্পের মূল্যায়ন করছেন সংস্থার গবেষকরা। ফল? অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
অর্থনীতিবিদ
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে কথা বললেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
আমরা কি দারিদ্রহীন বিশ্ব দেখে যেতে পারব?
চার দিকে এখনও অনেক গরিব মানুষ। কিন্তু আগের যে কোনও সময়ের চাইতে গড়পড়তা মানুষ এখন ভাল রয়েছে। ১৯৫৫ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর, এখন প্রায় ৭০। ১৯৫০ সালে বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর ছিলেন, ভারতে স্বাধীনতার সময়ে ২০ শতাংশেরও অক্ষরপরিচয় ছিল না। এখন ভারতে ৭৫ শতাংশই লিখতে-পড়তে পারেন, বিশ্বে ৮৫ শতাংশ। ভারতে এখন জাতীয় দারিদ্র সূচক ২২ শতাংশ মানুষকে ‘গরিব’ বলে ধরছে। আমার নিজের হিসেব দেখাচ্ছে, চল্লিশের দশকে ৯০ শতাংশ মানুষ গরিব ছিলেন।
বামপন্থীরা তো বলছেন, দারিদ্র বাড়ছে। কারণ, সাধারণ মানুষ আগের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছে।
ক্যালরির হিসেবে খাওয়া আগের তুলনায় কমেছে, এটা ঠিক। তবে খাবার কেনার পয়সা নেই বলে লোকে কম খাচ্ছে, এটা ধরে নেওয়া চলে না। জঁ দ্রেজ দেখিয়েছেন, আগের মতো দৈহিক শ্রম আর লোকে করছে না, তাই ক্যালরির প্রয়োজন কমছে। অন্য দিকে গরিবের সামনে এখন অনেক প্রলোভন। টিভি, মোবাইল ফোন কেনার তীব্র ইচ্ছে। খাবার কম কিনে সে এগুলোর খরচ মেটাচ্ছে, এমনও ইঙ্গিত মিলছে। দারিদ্র বাড়ছে বলেই মানুষ কম খাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে না। বিশেষত ১৯৯০ সালের পর শিশুমৃত্যু হারের মতো নানা সূচক দারিদ্র কমারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দরিদ্রের খাওয়া কমাটা যে চিন্তার বিষয় নয়, তা নয় এত কম পুষ্টির কুফল তো আছেই। কিন্তু শুধু দারিদ্রকে দায়ী করলে আমরা ভুলে যাই, আসলে লোকে খাওয়াটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। যত দিন লোকে পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন না হবে, তত দিন এর সমাধান দুরূহ।
শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে দেখলে হবে না। এক সময় অম্বেডকরকে কলেজ থেকে সরিয়ে দিতে আন্দোলন করেছিলেন তাঁর কলেজের শিক্ষকরা। এখন দলিত ছেলেমেয়েরা স্কুলে সবার সঙ্গে বসে মিড ডে মিল খাচ্ছে। দলিত ব্যক্তিদের আয়ের সঙ্গে অন্যদের আয়ের তফাত গত দু’দশকে অনেকটা কমেছে। গরিব কী করতে পারে, গরিব দেশ কী করতে পারে, সে বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা বদলেছে। এটাও গুরুত্বপূর্ণ।
তা হলে এখন চ্যালেঞ্জ কী?
গরিবের জন্য বরাদ্দ টাকা নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করা। দারিদ্র দূর করতে প্রায় সব দেশের সরকার প্রচুর টাকা খরচ করছে। কিন্তু সে তুলনায় ফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, আমরা ধরে নিচ্ছি স্কুল খুললে গরিব ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হবে, বেশি রোজগার করবে। স্কুল তৈরি করতে, শিক্ষকদের মাইনে দিতে প্রচুর খরচ হচ্ছে। প্রাথমিক স্কুলে প্রায় সব ছেলেমেয়ে যাচ্ছে। অথচ, তিন-চার বছর স্কুলে যাওয়ার পরেও অর্ধেকের বেশি ছাত্র লিখতে-পড়তে শিখছে না। মজুর পরিবারের সন্তান স্কুলে পড়ার পরেও মজুরিই করছে। সেই রকম, খাদ্য নিরাপত্তায় ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে সরকার। কিন্তু এত বছর শস্তায় চাল-গম দিয়ে অপুষ্টি কমেনি, এখনও কমবে কি না স্পষ্ট নয়। আজ সমস্যাটা এই নয় যে, দারিদ্র বাড়ছে। সমস্যা এই যে, কী করলে দারিদ্র কমবে, আমরা তার খেই পাচ্ছি না। |
|
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এসথার দুফলো। হায়দরাবাদ। ছবি: ডেভিড ব্যারন। |
আপনাদের ‘আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ দশ বছর ধরে নানা দেশে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে। কী বোঝা গেল?
আমরা বুঝেছি যে, কোনও একটি উপায়ে দারিদ্র ঘুচবে, এমন নয়। নির্দিষ্ট সমস্যার নির্দিষ্ট সমাধান খুঁজতে হবে। আর তা খুঁজতে হবে সতর্ক হয়ে, সুচিন্তিত পদ্ধতিতে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। নানা পরীক্ষার ফল থেকে কোনও একটি সমাধান কার্যকর বলে প্রমাণিত হলে, তার ভিত্তিতে সরকারকে নীতি বা প্রকল্প তৈরি করতে হবে।
যেমন শিক্ষার মানের প্রশ্নে আমরা দেখছি, পড়াশোনা যেখানে সিলেবাসমুখী, সেখানে ছাত্রদের শেখার মান ভাল হয় না। যেখানে ছাত্র-মুখী, সেখানেই শিশুরা শেখে বেশি। মানে, তৃতীয় শ্রেণির পাঠক্রম শেষ করাটা বড় হয়ে উঠলে হবে না। তৃতীয় শ্রেণির যে ছাত্র যে অবধি শিখেছে, তাকে সেখান থেকে শেখানো শুরু করতে হবে। সে জন্য প্রথম শ্রেণির বই থেকে আবার শুরু করতে হতে পারে। এ ভাবে ফাঁক ভরিয়ে প্রত্যাশিত মানে নিয়ে আসা কঠিন নয়।
আর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে?
রোগ প্রতিরোধের উপায়, সেটা মশারি থেকে টিকা যা-ই হোক, বিনা পয়সায় না দিলে ব্যবহার কমবে। অনেকে মনে করেন, বিনা পয়সায় পেলে লোকে এগুলো অবহেলা করে, তার চেয়ে কিছু দাম নেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা থেকে স্পষ্ট যে, পয়সা দিয়ে লোকে টিকা নেবে, সেটা দুরাশা। ও ভাবে রোগ প্রতিরোধের ‘চাহিদা’ তৈরি করা যাবে না। বরং টিকা নেওয়া বা মশারি ব্যবহারে উৎসাহ দিতে সামান্য কিছু উপহার দিলে কাজ বেশি হবে।
গরিবের রোজগার বাড়ানোর প্রকল্পগুলো কতটা কাজে দিচ্ছে?
আমাদের কাজ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, ব্যবসার জন্য গরিবকে ক্ষুদ্রঋণ (মাইক্রো-ফাইন্যান্স) দিলে তার আয়ে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। তার মানে এই নয় যে, ঋণ তার কাজে লাগে না। ওই টাকা দিয়ে সে বাড়ি সারায়, মেয়ের বিয়ে দেয়, সাইকেল কেনে। অনেকে ছোটখাটো ব্যবসাও করে। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণের টাকায় ছোট ব্যবসা বড় হচ্ছে, পরিবার দারিদ্র সীমার নীচে থেকে উপরে উঠছে, এমন ঘটছে না। মঙ্গোলিয়া, পেরু, ফিলিপিন্স, মেক্সিকো, মরক্কো, ভারত, সর্বত্র এর স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
তবে ভাল খবর হল, একেবারে হতদরিদ্র মানুষকে ছাগল, গরুর মতো কোনও সম্পদ দিলে, সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণ দিলে, তাঁরা রোজগার বাড়াতে পারছেন। এবং সেই বৃদ্ধি স্থায়ী হচ্ছে। বাংলাদেশ, পেরু, ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ছাগল-গরু পাওয়ার আড়াই বছর কেটে যাওয়ার পরও পরিবারগুলি আগের অতি-দরিদ্র অবস্থায় ফিরে যায়নি।
এ সব প্রমাণ পেয়ে সরকারি কর্তারা কী বলেন?
দশ বছরে আমাদের কিছুটা কনস্টিটিউয়েন্সি তৈরি হয়েছে। মানে বলতে পারেন, আমাদের কথা কিছুটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা, পঞ্জাব সরকার সুযোগ দিচ্ছে, নানা উপায়ে ছাত্রদের শেখার ফাঁক ভরাট করতে। এখানে কাজটা হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে। আফ্রিকার ঘানায় ‘ঘানা এডুকেশন সার্ভিস’-এর মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। আমাদের পরীক্ষায় প্রমাণিত, পেটের কৃমি সারালে স্কুলে অনুপস্থিতি ২৫ শতাংশ কমে। এখন অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, দিল্লি, রাজস্থানে স্কুল-পড়ুয়াদের কৃমির ওষুধ খাওয়াচ্ছে সরকার। ইথিয়োপিয়া, কিনিয়া, গাম্বিয়াতেও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
তবে বহু ক্ষেত্রে কোথায় সমস্যা, কীসে সমাধান, সে বিষয়ে প্রমাণ হাতে তুলে দিলেও সরকারি কর্তারা বলেন, “ঠিক, কিন্তু আমরা কী করব? কী করে করব?” দশ বছরে আমরা বুঝেছি, সরকারি প্রকল্পে সংস্কার আনা সহজ নয়। পরামর্শ থেকে রূপায়ণ পর্যন্ত একটা সার্বিক সহায়ক ব্যবস্থা দরকার।
সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে প্রমাণ পেশ করছেন না কেন? প্রকল্পে সংস্কার আনতে নীচ থেকেও তো চাপ তৈরি হতে পারে?
যে তথ্যগুলো সহজে বোঝা যায়, এবং তার ভিত্তিতে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, সেগুলো মানুষের কাছে পেশ করলে কাজ হতে পারে। যেমন, দিল্লির পুরনির্বাচনের আগে আমরা একটি হিন্দি দৈনিকে কাউন্সিলরদের ‘রিপোর্ট কার্ড’ ছেপে দেখিয়েছিলাম, কে কত দিন কাজ করেছেন, কার নামে কী দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তার ভিত্তিতে ভোটের নকশায় যে রদবদল হয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্তরা ভোট কম পেয়েছে, তারও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের বিষয়, যেমন শিক্ষার মানের উন্নতি, কিংবা টিকাকরণের হারে বৃদ্ধি, সেখানে সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করা কঠিন। দারিদ্র কমাতে এগুলি জরুরি হলেও, গরিবের কাছে এগুলোর চাহিদা নেই।
মন্ত্রীদের কাছেও চাহিদা আছে কি? প্রলোভন দেখিয়ে গরিবের ভোট পাওয়া সোজা। প্রমাণ দেখতে তাঁদের আগ্রহ হবে কেন?
প্রলোভন প্রমাণকে বার বার ছাড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু ভোটার বোকা নয়। বিনা পয়সায় জল, বিদ্যুৎ, এ সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট কেনা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। নেতা-মন্ত্রীরা যদি বলেন, ‘অপুষ্টি কমাতে চাই,’ তা হলে আমরা বলতে পারি, কী করলে তা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু যদি তাঁরা বলেন, ‘দু-টাকা কিলো চাল দিতে চাই,’ তা হলে তা কাজে লাগবে কি না, বা কতটা কাজে লাগবে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু বলার আর কোনও সুযোগ থাকে না। |
|
|
|
|
|