|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
হাইকোর্ট কিন্তু জানলাটা খুলে দিয়েছিল |
শাশ্বতী ঘোষ |
আজ অনেকের ঋতুপর্ণ ঘোষকে মনে পড়ছে। রূপান্তরকামী চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর লিঙ্গ পরিচিতিকে প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের শিল্পে। কিন্তু ঋতুপর্ণ যে দিন মারা যান, সে দিন এল জি বি টি কিউ (লেসবিয়ান গে বাইসেকশুয়াল ট্রান্সজেন্ডার কোয়েশ্চনিং/কুয়্যর) গোষ্ঠীর বন্ধুরা রবীন্দ্রসদনে তাঁদের সম্মান জানানোর অধিকার পাননি। তখন কেউ এসে গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের বঞ্চনায় সহমর্মিতা জানাননি। সেটা ছিল একটি রাজনীতি। সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতা প্রসঙ্গে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে সংবিধানসম্মত বলেছে। দিল্লি হাইকোর্ট যাকে অসাংবিধানিক বলে অভিধা দিয়ে আইনসভাকে সেই ধারা বাতিল করার উদ্যোগ নিতে বলে রায় দিয়েছিল, সর্বোচ্চ আদালত সংসদকেই আইন সংশোধনের কথা ভাবতে বলে সে রায় নাকচ করে দিল।
২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দেয় ৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিক, কারণ তা সংবিধানের চোখে সমতার বিরোধী লোকচক্ষুর আড়ালে প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতির ভিত্তিতে কিছু যৌনাচরণকে তা দণ্ডনীয় করেছে। দিল্লি হাইকোর্টের মূল যুক্তি ছিল, ৩৭৭ ধারা সংবিধানের ১৪ (আইনের চোখে সমতা), ১৫ (ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যহীনতা) আর ২১ (জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার) ধারার বিরোধী। সেই সঙ্গে সংসদকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শও দেয় হাইকোর্ট। এই রায়কেই সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানায় বেশ কয়েকটি সংগঠন, তখন সব ধর্মের নেতারা এক হয়ে গিয়েছিলেন। আবেদনকারীদের মধ্যে সংগঠনগত ভাবে ছিল তামিলনাড়ু মুসলিম মুন্নেত্রা কাজাগম, রেজা অ্যাকাডেমি, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড, উৎকল ক্রিশ্চিয়ান কাউন্সিল, অ্যাপস্টলিক চার্চের অ্যালায়েন্স, ট্রাস্ট গড মিশনারিজ থেকে ক্রান্তিকারী মনুবাদী মোর্চা পার্টি, দিল্লি সনাতন ধরম প্রতিনিধি সভা। বাকি অনেকে সংগঠন নয়, নিজস্ব নামে ছিলেন, তাই এখানে আর উল্লেখ করলাম না। অন্য দিকে, দিল্লি হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার জন্য যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সমকামী সন্তানদের মা-বাবাদের ১৯ জন ও ২০ জন ডাক্তার। সমকামীদের অধিকার, এইচ আই ভি-এড্স নিয়ে কর্মরত নাজ ফাউন্ডেশনের মূল আবেদনের সঙ্গে আরও বহু ব্যক্তি ও সংস্থা, পক্ষে বা বিপক্ষে, পার্টি হয়েছিলেন। হাইকোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপকতা বোঝাতেই সংশ্লিষ্টদের তালিকা।
সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টের রায়কে বাতিল করেছে। বলেছে, আইন বদল আদালতের মুখ্য কর্তব্য নয়, তা সংসদের দায়িত্ব। কেন বাতিল করা হলে, তা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে যুক্তিগুলি দিয়েছে, আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই প্রশ্ন তোলা যায়, তার কয়েকটি খুব বিপজ্জনক নয় কি? |
|
আরও কত লড়াই? ভুবনেশ্বর, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩। ছবি: পি টি আই। |
সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ (প্যারা ৪৩) বলল, দিল্লি হাইকোর্ট ৩৭৭ ধারার নমনীয় ব্যাখ্যা (রিডিং ডাউন) করতে গিয়ে যে ‘সামান্য সংখ্যক’ (১৫০ বছরে ২০০ জন) এই আইনে ধরা পড়েছে, তাদের সংখ্যাকে গণ্য করেনি। তার মানে তো হয় যে, কম সংখ্যক মানুষ কোনও অন্যায়ের শিকার হলে তা নিয়ে আদালতের মাথা ঘামানোর দরকার নেই? ভারতে বছরে কত জন সতী হচ্ছিলেন, যে রূপ কাঁওয়ারের সতী হবার পর সতী-বিরোধী আইন সংশোধন করতে হল? বরং একটা গোষ্ঠী যত ছোট, গণতন্ত্রে তাদের অধিকার রক্ষার দায় তো শাসনতন্ত্রের অভিভাবকদের উপরে আরওই বেশি করে বর্তায়।
দ্বিতীয়ত, দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা এ দেশের ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়োগ করা হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি জানাতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বলেছে: ‘ইন ইট্স অ্যাংজাইটি টু প্রোটেক্ট দ্য সো-কল্ড রাইটস অব এলজিবিটি পারসন্স...’ যেন দিল্লি হাইকোর্ট কোনও যুক্তি ছাড়াই ৩৭৭ ধারাকে সম্মতির ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সমকাম অপরাধ নয় বলে গণ্য করেছে। আর, এই ‘সো-কল্ড রাইটস’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাওয়া হয়েছে, সেই প্রশ্নও থেকেই যায়। সংশয় হয়, এই মন্তব্যে বিচারপতিদের ভিতরের বিমুখতা প্রকাশ পায়নি তো?
সুপ্রিম কোর্ট তো সাম্প্রতিক কালে নিজে থেকে কে লালবাতি লাগাবে, পলিগ্রাফ টেস্ট করা যাবে কি না, এ সব নানা বিষয়ে এগিয়ে গিয়ে রায় দিয়েছে, খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু ৩৭৭ ধারা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যা বলল, যে ভাবে বলল, সেটা অন্য ধারার অনুসারী। সর্বোচ্চ আদালত এ ক্ষেত্রে জানাল, ১৯৫০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধি গৃহীত হওয়ার পরে ৩০টি সংশোধন হয়েছে, সবচেয়ে সম্প্রতিটি হয়েছে ২০১৩ সালে, তাও যৌননিগ্রহ নিয়ে, ৩৭৭ ধারাও তো তার মধ্যেই পড়ে, তা হলে সংশোধন করেনি কেন? সে প্রশ্ন তো আমাদের অনেকের। প্রসঙ্গত, নারী ও সমকামী অধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলি ৩৭৭ ধারা বাতিল করার পক্ষে মত দিলেও বর্মা কমিশন তার রিপোর্টে সেই সুপারিশ করেনি।
অথচ গীতা হরিহরণ বনাম রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া মামলায় হিন্দু নাবালক ও অভিভাবকত্ব আইনের ৬ ধারাকে নমনীয় ভাবে ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্ট মাকেও অভিভাবকত্ব দিয়েছে, বলেছে, তা না দেওয়াটা সংবিধানের ১৪ ও ১৫ ধারার পরিপন্থী। ৩৭৭ ধারার ক্ষেত্রে সব ধর্মের সংগঠনেরা একসঙ্গে দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করেছে। সে জন্যই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আরও দুর্ভাগ্যজনক।
আর একটা প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক। ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট শিশু ও যে-কোনও অসম্মত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনাচরণকে শাস্তিযোগ্য রাখবে বলে ৩৭৭ ধারা পুরোপুরি বাতিল করার সুপারিশ করেনি, কারণ তখনও শিশুদের যৌন নিগ্রহ বিরোধী আইন কার্যকর হয়নি। কিন্তু সেই আইন ২০১২ সালে কার্যকর হয়েছে। ২০১৩ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি যৌন নিগ্রহের সংজ্ঞাকে আরও ব্যাপক করেছে, তাই এখন ৩৭৭ ধারা পুরোপুরি বাতিলের পথে তো কোনও বাধা নেই।
দুর্ভাগ্যক্রমে, দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রে রাজনীতি, সংসদ, জনপ্রতিনিধি এই সব শব্দ মানুষের চোখে তাদের মর্যাদা অনেকখানি হারিয়েছে। মর্যাদার বিচারে তাদের জায়গা নিয়েছে আদালত, সিবিআই, সেনাবাহিনী, আগামী দিনে হয়তো লোকপাল। আমরা ধরে নিতে শুরু করেছি, এরাই আমাদের ন্যায় দিতে পারবে, কারণ এরা যেন দুর্নীতির ঊর্ধ্বে, এরা যেন ভোট-ব্যাংকের রাজনীতি দিয়ে চলে না। এর পাশাপাশি রয়েছে সমাজের একটা অংশের অধিকারের দাবিতে সংগঠিত সরবতার সাম্প্রতিক ইতিহাস। দিল্লির বাসে গণধর্ষণের ঘটনার পরে যে সম্মিলিত ক্রোধ আর ক্ষোভের প্রকাশ
আপাতত কংগ্রেস ৩৭৭ ধারা বাতিল করার (বা সংশোধনের) পক্ষে, বিজেপি বিপক্ষে। অন্য রাজনৈতিক দলরা কে কোথায়, সেই জল মাপা শুরু হবে কি এ বার? না কি ধর্মীয় সমাজের চাপে ন্যুব্জ জনপ্রতিনিধিদের অপেক্ষায় না-থেকে আবার রিভিয়ু পিটিশন দাখিল করে সুপ্রিম কোর্টের ভরসাতেই থাকতে হবে আমাদের? |
|
|
|
|
|